Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ওঁরা পুজো উদ্বোধন করবেন আর আমি জেলে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনব!

পঞ্চমীর দুপুরেই দোদমার গর্জন। একটি এল কুণাল ঘোষের কাছ থেকে। অন্যটি সুদীপ্ত সেনের। গত ৬ সেপ্টেম্বর বিচারভবনের সিবিআই আদালতে সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ বলেছিলেন, সারদা মিডিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা যদি সবথেকে বেশি কেউ পেয়ে থাকেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৩ দিন পরে ওই আদালতেরই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কুণাল বললেন, “যারা সারদার কাছে সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরা বাইরে পুজোর উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। আমি জেলে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনব, এটা হতে পারে না। আমি আদালতের কাছে ১৬৪ ধারা মোতাবেক গোপন জবানবন্দি দিতে চাই।”

ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কুণাল ঘোষ। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কুণাল ঘোষ। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

পঞ্চমীর দুপুরেই দোদমার গর্জন। একটি এল কুণাল ঘোষের কাছ থেকে। অন্যটি সুদীপ্ত সেনের।

গত ৬ সেপ্টেম্বর বিচারভবনের সিবিআই আদালতে সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ বলেছিলেন, সারদা মিডিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা যদি সবথেকে বেশি কেউ পেয়ে থাকেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২৩ দিন পরে ওই আদালতেরই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কুণাল বললেন, “যারা সারদার কাছে সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরা বাইরে পুজোর উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। আমি জেলে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনব, এটা হতে পারে না। আমি আদালতের কাছে ১৬৪ ধারা মোতাবেক গোপন জবানবন্দি দিতে চাই।”

এই বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে ওই একই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সুদীপ্ত সেন বলে গিয়েছেন: “এত দিন মুখ খুলিনি। এ বার একটা তারিখ ঠিক করুন। আমি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলব। সব প্রশ্নের উত্তর দেব। তা ভিডিও রেকর্ডিং করে সিবিআইকে ‘হ্যান্ডওভার’ করা হোক।”

এক দিকে সুদীপ্তর মুখ খুলতে চাওয়া এবং অন্য দিকে কুণালের গোপন জবানবন্দি দেওয়ার আর্জি-র এই জোড়া ধাক্কায় সোমবার শোরগোল পড়ে যায় রাজনীতিক এবং আইনজীবীদের মধ্যে। অনেকেরই মনে পড়ছিল, ২০১১ সালের কথা। সে বার গড়পারে কুণালের পাড়ায় রামমোহন সম্মিলনীর পুজো মহা ধুমধামে উদ্বোধন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কুণাল কি এ দিন তাঁর কথার মধ্যে দিয়ে সেই সব অনুষঙ্গও পরোক্ষে উস্কে দিলেন না?

তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কেবল বলেন, “এত দেরি করছে কেন? (জবানবন্দি) দিয়ে দিক না! আমি মা-র কাছে প্রার্থনা করছি, কুণালের মানসিক সুস্থতা দ্রুত ফিরুক। ও ফের সাংবাদিক কুণাল হয়ে উঠুক।”

এর আগে, গ্রেফতার হওয়ার পরপরই বিধাননগর আদালতে দাঁড়িয়ে ১৬৪ ধারায় গোপন জবানবন্দি দিতে চেয়েছিলেন কুণাল। আদালত তাঁকে অনুমতি দেয়। তিনি কী বলবেন, ভাবার জন্য তাঁকে সময়ও দেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যেই কুণালকে হাওড়ার একটি মামলায় হাজির করাতে নিয়ে যায় রাজ্য পুলিশ। সে যাত্রা কুণালের জবানবন্দি দেওয়া হয়নি। সারদা মামলা সিবিআইয়ে যাওয়ার পরে কুণাল দাবি করেন, তিনি যাতে গোপন জবানবন্দি না দেন, তার জন্য তাঁর উপরে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করা হয়েছিল।

কেন কুণাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দিতে চাইছেন? এ দিন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ। তিনি বলেন, “এই জবানবন্দি পরে চাইলেও আমি বদলাতে পারব না। তাই আমি যা জানি, তা নথিভুক্ত করতে চাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। কারণ, আমি না-ও থাকতে পারি। মরেও যেতে পারি। পারিপার্শ্বিক যা ঘটনা ঘটছে, তাতে পরে আমি কিছু না-ও বলতে পারি। তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। তদন্তকারী অফিসারও বদলি হয়ে যেতে পারেন।”

কুণালের আর্জি খারিজ করেননি বিচারক অরবিন্দ মিশ্র। আদালতে তিনি জানান, তদন্তকারী অফিসার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ২১ অক্টোবর রিপোর্ট জমা দেবেন। সিবিআইয়ের তরফে জানানো হয়, তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি আদালতকে জানানো হবে।

এমন মামলায় গোপন জবানবন্দির গুরুত্ব কী? আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “গুরুত্ব অপরিসীম। আদালতের কাছে এটাই গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য।” আইনজীবীদের একাংশের ধারণা, কুণাল ভেবেচিন্তেই গোপন জবানবন্দির চাল খেলেছেন। তাতে এই কেলেঙ্কারির আবহে অনেক প্রভাবশালীর ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হতে পারে।

এমনিতে কুণাল যাতে খোলাখুলি বেশি কথা বলতে না পারেন, তাই তাঁকে ইদানীং কড়া পুলিশি ঘেরাটোপে রাখা হচ্ছিল। তাঁর কথা যাতে সাংবাদিকরা শুনতে না পান, সে জন্য ‘হা রে রে রে’ চিৎকার এবং গাড়িতে চাপড় মেরে আওয়াজ করা শুরু করেছিল পুলিশ। আদালতে কুণাল বলতে শুরু করলে আইনজীবীদের একাংশও তাঁকে বাধা দিচ্ছিলেন। এ দিন এক আইনজীবীর মৃত্যুতে বিচারভবনে কাজে যোগ দেননি কোনও আইনজীবী। কুণাল ও সুদীপ্ত তাই সরাসরি নিজেদের বক্তব্য বিচারকের কাছে পেশ করেছেন।

আইনজীবীদের একাংশ দাবি করছেন, সুদীপ্ত যাতে মুখ না খোলেন তার জন্যও অনেক চেষ্টা করেছে শাসক দল। কারণ, তিনিও মুখ খুললে অনেক কিছু বেরিয়ে পড়বে বলে তাঁদের আশঙ্কা। সেই আশঙ্কাই আরও বাড়িয়ে এ দিন কুণাল সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের কাছে আরও তথ্য দেওয়ার কথা বলেছেন। বিচারক কুণালের এই আবেদনটি সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্জুর করেছেন। তিনি তদন্তকারীদের নির্দেশ দেন, জেলে গিয়ে তাঁর বয়ান নথিভুক্ত করা হবে। সিবিআই সূত্রের খবর, কয়েক দিনের মধ্যে এই বয়ান রেকর্ড করা হবে।

কুণালের মতোই এ বার মুখ খুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছন সুদীপ্ত সেনও। এ দিন তিনি বলেন, “আমি দেড় বছর ধরে চুপচাপ ছিলাম। আদালত আমাকে নির্দেশ দিয়েছিল, মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলতে। কিন্তু মিডিয়া হল ‘সার্চলাইট অব সোসাইটি’। এ বার একটা তারিখ ঠিক করুন। আমি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলব।” সিবিআই তদন্ত শুরুর পরে রাজ্যের চাপ যে তিনি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন এ দিন সুদীপ্তের কথায় তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

সারদা তদন্ত শুরু হওয়া ইস্তক কুণাল মাঝেমধ্যেই নানা বিস্ফোরক কথাবাার্ত বলে এসেছেন। তুলনায় চুপ ছিলেন সুদীপ্ত। পুলিশ তাঁকে ঘিরে রাখত, তিনিও গোড়ার দিকে দু’-এক বার ছাড়া পুলিশকে ডিঙিয়ে মুখ খোলার উৎসাহ দেখাননি। এক বার বলেছিলেন, সিটের তদন্ত ঠিক পথে চলছে। কিন্তু সেটা কতটা তাঁর নিজের কথা আর কতটা চাপের মুখে বলা, সে প্রশ্ন তখনই উঠেছিল। এত দিন পরে তিনি নিজে থেকে মুখ খুলতে চেয়ে সুদীপ্ত সেই প্রশ্নটাকেই মান্যতা দিলেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। মামলার একেবারে শুরুতে তিনি এও তো বলেছিলেন, সময় হলে সব বলবেন। এত দিনে কি তিনি মনে করছেন, সময় হল? জল্পনা চলছে আইনজীবী মহলে।

ঘটনাচক্রে এ দিনই সিটের বিরুদ্ধে সরাসরি গলা চড়িয়েছেন কুণালও। তিনি বলেন, “সিট আমার বাড়ি তছনছ করে তল্লাশি চালিয়েছে। গত ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার হওয়ার আগে বিধাননগর দক্ষিণ থানার পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। সিটকে একটি ফাইল দিয়েছিলাম। কিন্তু সিজার লিস্টে সেগুলো নেই। সিট সেগুলো ‘হ্যান্ড ওভার’ করেছিল কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।” এই কথা বলার সময় প্রায় কেঁদে ফেলেন কুণাল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আমি পাহাড়ে কোনও গোপন বৈঠক করিনি। যা করেছি টিভি ক্যামেরার সামনে করেছি। আমি মরে গেলেও পরের জন্মে প্রমাণ করব, আমি চোর নই।”

কুণালের এই অভিযোগের ব্যাপারে সিটের কর্তা রাজীব কুমার ও অর্ণব ঘোষ কেউই মুখ খোলেননি। রাজীব বলেন, “এ ব্যাপারে মন্তব্য করব না।” বর্তমানে নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব কৃষ্ণনগরে তাঁর দফতরে বসে বলেন, “এ বিষয়ে মন্তব্য করার এক্তিয়ার এখন আমার নেই।”

তবে সুদীপ্ত ও কুণালের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম এ দিন দাবি তোলেন, “সিট এবং সংশ্লিষ্ট অন্য পুলিশ-কর্তাদের জেরা করা উচিত সিবিআইয়ের। কার নির্দেশে তাঁরা কী কী ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই বৃত্ত তা হলে সম্পূর্ণ হবে!” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ আবার অন্য একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাঁর অভিযোগ, “কুণাল আসলে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে দর কষাকষি করছেন। সে জন্যই এক বারে সব তথ্য না-দিয়ে থেমে থেমে দিচ্ছেন।

আর মাঝে মাঝে বলছেন আরও তথ্য দিতে চান।”

অ্যাকাউন্ট সিল

কিংফিশার-ইস্টবেঙ্গল লিমিটেডের অ্যাকাউন্ট সিল করে দিল ইডি। ইডি-র সন্দেহ, সারদা থেকে যত টাকা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে গিয়েছে, তার অধিকাংশই জমা পড়েছে ওই অ্যাকাউন্টে। ওই অ্যাকাউন্ট থেকেই ক্লাবের খেলোয়াড়দের টাকা দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে, সমস্যায় পড়ে গিয়েছে ক্লাব। ইডি সূত্রের খবর, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্ট থেকে কোনও লেনদেন করা যাবে না। অন্য ক্লাবের কোনও অ্যাকাউন্টে সারদার টাকা থাকলে তাও সিল করা হবে বলে ইডি জানিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE