Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সারদায় মমতা-নাম এ বার মদনের তরফে

ভরা এজলাসে সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামকে জড়িয়ে দিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। এ বার সারদা-কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর নাম আদালতে তুললেন তাঁরই সরকারের মন্ত্রী মদন মিত্রের কৌঁসুলি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৫ ০৪:৫৬
Share: Save:

ভরা এজলাসে সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামকে জড়িয়ে দিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। এ বার সারদা-কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর নাম আদালতে তুললেন তাঁরই সরকারের মন্ত্রী মদন মিত্রের কৌঁসুলি।

এবং বৃহস্পতিবার আলিপুর আদালতে জামিন-মামলার শুনানিতে সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত মদনবাবুর তরফে এ ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর নাম উঠে আসায় রাজনীতিকদের মহলে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। কেউ কেউ ‘অন্য গন্ধ’ পেতে শুরু করেছেন। অনেক আইনজীবীও বিস্ময় লুকোতে পারছেন না। মদনবাবুর জামিন-আর্জিটি অবশ্য খারিজ হয়ে গিয়েছে।

সারদা-কেলেঙ্কারির জেরে পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবুকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে ছ’মাস হয়ে গেল। এ দিন আলিপুরের প্রথম জেলা ও দায়রা আদালতে তাঁর জামিন-আর্জির শুনানি ছিল। সেখানে সওয়াল করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নাম টেনে আনেন মদনবাবুর কৌঁসুলি মিলন মুখোপাধ্যায়— আশরাফুল হক নামে মামলার এক সাক্ষী সিবিআই’কে যে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন, তারই সূত্র ধরে। কী রকম?

মিলনবাবু সওয়ালে বলেন, মালদহের বাসিন্দা আশরাফুলের বয়ান অনুযায়ী, তিনি সারদার অফিসে গিয়ে মদন মিত্রের নাম দেখে প্রভাবিত হয়ে টাকা রেখেছিলেন। পাশাপাশি সারদার কলম পত্রিকার উদ্বোধনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেও তিনি প্রভাবিত হন। ‘‘দেখা যাচ্ছে, সাক্ষীদের জবানবন্দিতে মদন ছাড়াও আরও অনেকের নাম রয়েছে। তা হলে শুধু মদন মিত্র জেলে কেন?’’— আদালতে প্রশ্ন তুলেছেন মিলনবাবু।

তাঁর প্রশ্নের মধ্যে ‘তাৎপর্য’ খুঁজে পাচ্ছেন আইনজীবী মহলের একাংশ ও বিরোধী নেতারা। ওঁদের পর্যবেক্ষণ, মমতার নাম তুলে মিলনবাবু এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, অভিযোগকারী মদন মিত্রের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেও সারদায় টাকা রাখতে উৎসাহী হওয়ার কথা বলেছেন, অথচ ফেঁসে গিয়েছেন শুধু মদনই! ‘‘মিলনবাবু নন, কোর্টে মমতার নাম তুলিয়েছেন মদন মিত্র স্বয়ং। সারদার সব দায় নিয়ে তিনি একা জেল খাটছেন, এটা মেনে নিতে তাঁর কষ্ট হওয়ারই কথা!’’— বলছেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী। তাঁর মতে, খোদ মদনের তরফে মমতার নাম এ ভাবে আদালতে তুলে দেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বিজেপি’র জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘‘যে যুক্তিতে মদন জেল খাটছেন, একই যুক্তিতে মমতারও জেলে থাকার কথা।’’ আর সুপ্রিম কোর্টে যাঁর আবেদনের জেরে সারদায় সিবিআই-তদন্ত হচ্ছে, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সাধারণ মানুষ সারদা-কাণ্ডে মমতার গ্রেফতারি চেয়েছিলেন। মদনের কৌঁসুলির বক্তব্যে সেটাই স্বীকৃতি পেল।’’

মিলনবাবুর অবশ্য দাবি, তাঁর এ দিনের সওয়ালের পিছনে মক্কেলের কোনও ভূমিকা নেই, এবং ওই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি অন্য কিছু বোঝাতেও চাননি। এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে মিলনবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘আমি শুধু আদালতে ওই সাক্ষীর বয়ানটি পড়েছি। কিছু ইঙ্গিত করতে চাইনি। আইনজীবী হিসেবে এটা ঠিক মনে করেছি। কারও নির্দেশে কিছু করিনি।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি।

মিলনবাবু প্রথম নন। এর আগে সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে মমতার নাম জড়িয়ে আদালতে বিস্ফোরক মন্তব্য করে গিয়েছেন মমতারই দলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষ। সারদা-কাণ্ডে ধৃত কুণালের বক্তব্য ছিল, সারদার সংবাদমাধ্যম থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা কেউ যদি পেয়ে থাকেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত দুর্গাপুজোর মুখে কোর্ট চত্বরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে কুণাল এ-ও বলেন, ‘‘কেউ পুজো উদ্বোধন করে বেড়াবে, আর কেউ জেলের ভিতরে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনবে, এ হতে পারে না।’’

সারদা কেলেঙ্কারির সব দায় নিয়ে দলের মধ্যে একাই তাঁকে জেল খাটতে হচ্ছে বলে বারবারই আদালতে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কুণাল। ‘হা রে রে রে’ চিৎকারে তাঁর বাক্যবাণ চাপা দেওয়ার জন্য আদালতের বাইরে বিশেষ পুলিশও রাখা হতে থাকে। পরে তৃণমূলের আর এক প্রাক্তন নেতা আসিফ খানও মমতাকে নিশানা করেন। আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে মমতাকে সরাসরি ‘ডাকাতরানি’ তকমায় ভূষিত করে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দেন তিনি।

তবে কুণাল বা আসিফের সঙ্গে মদনের বিস্তর ফারাক। কারণ, ওঁদের দু’জনকেই গ্রেফতার করেছিল রাজ্য পুলিশ। রাজ্যের শাসকদল বা সরকার— কেউ তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। অন্য দিকে সিবিআইয়ের হাতে মদন-গ্রেফতারির প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী-সহ গোটা দলই রাস্তায় নেমে পড়েছিল। এমনকী, মদন জেলে যাওয়ার পরেও মমতা তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেননি। উপরন্তু তিনি জেলে থেকেও যাতে চিকিৎসার জন্য ‘ভিভিআইপি’ সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন, সরকারের তরফে তার যাবতীয় বন্দোবস্ত মজুত।

কিন্তু টানা ছ’মাসের বন্দিত্ব মদনের মনে কিছুটা হলেও যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, সেটা সম্প্রতি তাঁর কথাবার্তায় টের পাওয়া গিয়েছে। ঘনিষ্ঠদের কাছে তিনি বারবার আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘‘দলনেত্রীর উপরে আস্থা রাখার ফল পাচ্ছি। সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি জেলে পচছি!’’

এবং মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, এ দিন কার্যত সেই আক্ষেপেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কৌঁসুলির সওয়ালে। আদালতে মিলনবাবু জানান, ২০১৩-য় মালদহের চাঁচল থানায় বাসিন্দা আশরাফুল সারদার নামে যে প্রতারণার অভিযোগটি দায়ের করেছিলেন, তাতে কোথাও মদন মিত্রের নাম ছিল না। পরে সিবিআইয়ের কাছে জবানবন্দিতে তিনি মদন মিত্রের নাম উল্লেখ করেন। মিলনবাবুর দাবি: সিবিআই’কে আশরাফুল জানিয়েছেন, তিনি তিনটি ঘটনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রথমত, তিনি সারদার অফিসে মদন মিত্রের নাম লেখা একটি বোর্ড দেখেন। সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনও হামেশা বলতেন, ‘কিছু হলে মদনদাই সামলে দেবেন।’ দ্বিতীয়ত, কলম পত্রিকার উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে তিনি আরও আশ্বস্ত হন। তৃতীয়ত, উত্তরবঙ্গের এক নেতাও তাঁকে সারদায় টাকা রাখতে উৎসাহিত করেছিলেন।

সারদার ওই আমানতকারী আশরাফুল হক নিজেও এ দিন মদন মিত্রের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেছেন। চাঁচলের বাড়িতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘মদন মিত্রের নাম দেখলাম। দেখতে পেলাম, কলম পত্রিকার উদ্বোধন করছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে! ভাবলাম, সারদা কোম্পানি তো ভালই চলছে, এখানেই তা হলে টাকা রাখি। তখন কে জানত, এমন হবে?’’

মদনবাবুর জামিন-মামলায় এ দিন পাল্টা সওয়ালে যুক্তি সাজিয়েছিলেন সিবিআইয়ের কৌঁসুলি কে রাঘবচারিলু। তিনি বলেন, প্রায় দু’শো দিন গ্রেফতার হয়ে থাকার পরেও মদন মিত্রের মন্ত্রিত্ব বহাল। উপরন্তু এর বেশিটাই মন্ত্রী কাটিয়েছেন হাসপাতালে, সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সমেত। তাঁর পরিবারের তরফে সাক্ষীদের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও সিবিআই-কৌঁসুলির অভিযোগ। ‘‘জননেতা তথা সারদার কর্মী-ইউনিয়নের নেতা মদন মিত্র সারদার স্বার্থে কার্যত নিজের ভাবমূর্তি, ও পদের ক্ষমতা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ বিনিয়োগ করেছেন, ঠকেছেন ও আত্মহত্যা করেছেন। এখনও তাঁর প্রভাব এতটুকুও কমেনি।’— দাবি করেন রাঘবচারিলু।

দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব শুনে বিচারক লক্ষ্মীকান্ত দাস মদনবাবুর জামিন-আবেদন খারিজ করে দেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE