Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

‘কষ্ট কম হল, ভগবান বোধ হয় খুশি হলেন না!’

পথে পথে ছড়ানো পাথর ভেঙে বা আদিগন্ত মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে হেঁটে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পুণ্য পেতে চান ঈশ্বরপ্রাণ তীর্থযাত্রীরা।

পুণ্যডুব: সংক্রান্তির স্নান। রবিবার গঙ্গাসাগরে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

পুণ্যডুব: সংক্রান্তির স্নান। রবিবার গঙ্গাসাগরে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

সুপ্রিয় তরফদার
গঙ্গাসাগর শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:৫৩
Share: Save:

প্রকৃতির এ কী প্রতারণা! পুণ্যের পথেও এমন বাগড়া কেন, জবাব পাচ্ছেন না সাগরসঙ্গমে মকরসংক্রান্তির স্নানে আসা অনেকে।

যেমন আক্ষেপ করছিলেন মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা এক দল বৃদ্ধা। আক্ষেপ যথেষ্ট ঠান্ডা নেই বলে। কৃচ্ছ্রসাধনে খামতি থেকে গেল না কি! কষ্ট না-করলে পুণ্য লাভ হয় না, স্নান করে ভিজে কাপড়েই জানিয়ে দিলেন ওই দলের এক বৃদ্ধা। বললেন, ‘‘সাগরস্নান হল। আফসোস এটাই যে, এ বার ঠান্ডা কম। কষ্ট কম হল। ভগবান বোধ হয় খুশি হলেন না।’’

পথে পথে ছড়ানো পাথর ভেঙে বা আদিগন্ত মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে হেঁটে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পুণ্য পেতে চান ঈশ্বরপ্রাণ তীর্থযাত্রীরা। টি এস এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, হাড়মাস কালিয়ে যাওয়া ঠান্ডায় পথ অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে কী ভাবে চলেছে তীর্থযাত্রা। রবিবারের গঙ্গাসাগর দেখাল, পুণ্যের পথে যথেষ্ট ক্লেশ না-পাওয়ার ক্লেশ কতটা ক্লিষ্ট করেছে তীর্থযাত্রীদের।

তারই মধ্যে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে, বুক পর্যন্ত জলে নেমে সূর্যপ্রণাম সারলেন পুণ্যার্থীরা। প্রত্যাশা অনুযায়ী ভিড়ে উপচে পড়ল গঙ্গাসাগর মেলা। পৌষসংক্রান্তির পুণ্যতিথিতে পুণ্য লাভের আশায় দশ থেকে আশি সকলেই ডুব দিলেন সাগরসঙ্গমে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার থেকে শুরু করে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে দল বেঁধে ভক্তেরা এসেছেন সাগরদ্বীপে। কেউ এসেছেন মহা-ভারতের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ দেখতে, কেউ বা ঈশ্বরে দেওয়া কথা রাখতে। দেখলেন। কথা রাখলেন সঙ্গমস্নান সেরে। আর সব কিছুর মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকল পর্যাপ্ত শীতের অভাববেদনা।

এ বারেই প্রথম সাগরস্নানে এসেছেন উত্তরপ্রদেশের আজাদ বাবা। ২০১৩ সালে ট্রাকের খালাসি থাকার সময়ে দুর্ঘটনায় পা কাটা যায়। তার পর থেকে বিভিন্ন আশ্রমে দিন কাটে তাঁর। সেই অবস্থাতেই পুণ্যের আশায় গঙ্গাসাগরে আসা।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে সামলানোর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল প্রশাসন। আকাশ, স্থল ও জলপথে নজরদারি চালিয়েছে তারা। তবে ঠান্ডা তুলনায় কম থাকায় স্নান সেরে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকার চিত্র খুবই বিরল। সেবাকাজের নানান নজির উঠে এসেছে মেলায়। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা জানান, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, বিহার-সহ বিভিন্ন রাজ্যের বেশ কিছু বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে এ দিন উদ্ধার করা হয়েছে। হাউ হাউ করে অসহায়ের মতো কাঁদতে দেখে তাঁদের উদ্ধার করে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বৃদ্ধবৃদ্ধারা জানান, পরিবারের সঙ্গে এলেও ছেলে ও অন্যান্য আত্মীয় তাঁদের সাগরপাড়ে রেখে চলে গিয়েছেন। ‘‘সত্তর বছরের এক বৃদ্ধা ঠিকানা হিসেবে শুধু বলতে পেরেছেন ঔরঙ্গাবাদের কথা। যোগাযোগ করা হয়েছে সেখানকার পুলিশের সঙ্গে। ওঁকে এবং ওঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে,’’ বলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক কর্তা।

তবে সার্বিক ভাবে এ দিন বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি বলেই জানান জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও। তবে বাস-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের ৬১ বছরের এক বৃদ্ধা। আহতদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এ বারের মেলা দেখে আপ্লুত পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। জানালেন, ১৫ বছরে কোনও মেলায় এমন ভিড় দেখেননি তিনি। প্রশংসা করলেন জেলা প্রশাসনের। সুব্রতবাবু জানান, গঙ্গাসাগরে থাকার জন্য হোগলার যে-সব আস্তানা গড়া হয়েছে, তা বদলানো হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বৈঠকে জানিয়েছিলেন, হোগলার ঘরে আগুন লাগার আশঙ্কা থাকে। সেগুলি টিনের করে দিলেই ভাল। ‘‘আগামী বছর থেকে এগুলিতে টিনের ছাউনি দেওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টাই করছি। কারণ মুখ্যমন্ত্রী দুর্ঘটনার আশঙ্কামুক্ত মেলা চাইছেন,’’ বললেন সুব্রতবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE