Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশ ক্যাম্পে ভরসা নেই মাখড়ার

এক দিকে, ১৪৪ ধারা জারি রাখতে সক্রিয় পুলিশের সঙ্গে চলছে বিজেপি-র প্রতিনিধি দলের ধস্তধস্তি। অন্য দিকে, তার কয়েক কিলোমিটার দূরেই এত দিনের চেনাছন্দ যেন হঠাত্‌ করেই থেমে গিয়েছে মাখড়া গ্রামে। বৃহস্পতিবার ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে এমন বিপরীত ছবিতেই যুজছে মাখড়াবাসী। অথচ গ্রামে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসেছে। দু’বেলা রাস্তায় চলছে রুট মার্চ। কিন্তু এ সব ‘আয়োজনে’র ২৪ ঘণ্টা পরেও বাসিন্দাদের ভরসা জোগাতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসনের এহেন উদ্যোগ।

চৌমণ্ডলপুরের আগে গাড়িতে চলছে তল্লাশি। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

চৌমণ্ডলপুরের আগে গাড়িতে চলছে তল্লাশি। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

মহেন্দ্র জেনা
মাখড়া শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৪৪
Share: Save:

এক দিকে, ১৪৪ ধারা জারি রাখতে সক্রিয় পুলিশের সঙ্গে চলছে বিজেপি-র প্রতিনিধি দলের ধস্তধস্তি। অন্য দিকে, তার কয়েক কিলোমিটার দূরেই এত দিনের চেনাছন্দ যেন হঠাত্‌ করেই থেমে গিয়েছে মাখড়া গ্রামে। বৃহস্পতিবার ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে এমন বিপরীত ছবিতেই যুজছে মাখড়াবাসী।

অথচ গ্রামে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসেছে। দু’বেলা রাস্তায় চলছে রুট মার্চ। কিন্তু এ সব ‘আয়োজনে’র ২৪ ঘণ্টা পরেও বাসিন্দাদের ভরসা জোগাতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসনের এহেন উদ্যোগ। উল্টে বাসিন্দাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাসের ছাপ। এ দিনও আতঙ্কিত মাখড়াবাসীর একাংশকে গ্রামের বাইরেই আশ্রয় নিতে দেখা গেল। ভিত সন্ত্রস্ত পরিবারগুলির একটিই জিজ্ঞাসা, আমাদের গ্রাম কবে আগের মতো হবে। জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে তাঁদের একটাই আর্জি, “আমরা শান্তি চাই।”

পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিজেপি-র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল আসার খবর পেয়ে এ দিন সকালে খানিকটা স্বস্তিতে ছিলেন ইলামবাজার ব্লকের পাশাপাশি দুই পঞ্চায়েতের দুই গ্রাম চৌমণ্ডলপুর ও মাখড়ার বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। এক গ্রাম চৌমণ্ডলপুর, যেখানকার বাসিন্দাদের একাংশের বিরুদ্ধে পুলিশকেই পেটানোর অভিযোগ রয়েছে। অন্য দিকে, লাগোয়া মাখড়া গ্রাম। যেখানে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষের তিন জন খুন হয়েছেন। ঘটনার পর থেকেই দুই গ্রাম কার্যত সন্ত্রাস কবলিত। কোথাও বাসিন্দারা সরাসরি পুলিশ এবং শাসক দলকে দুষছেন। কোথাও আবার পরোক্ষে পুলিশকেই এই তাণ্ডবে মদত দেওয়ায় অভিযুক্ত করছেন। এ দিন অবশ্য সকালে থেকেই এলাকার রাস্তায় পুলিশ, র্যাফ ও কমব্যাট বাহিনী তুলনায় বেশি ছিল। মাখড়ায় ঢোকার মুখে হাঁসড়া স্কুল মোড়ে হাঁসড়া-ইলামবাজার ও বোলপুর যাওয়ার রাস্তার উপর বাহিনী নিয়ে ব্যারিকেড করে হাজির ছিলেন খোদ এসডিপিও (বোলপুর) সূর্যপ্রতাপ যাদব। আরও বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড গড়েছেন এসডিপিও (রামপুরহাট) কোটেশ্বর রাও এবং সিআই (বোলপুর) চন্দ্রশেখর দাস। যেখান দিয়ে মাছি গলারও উপায় ছিল না। এলাকায় এমন নিশ্ছিদ্র ‘নিরাপত্তা’ ব্যবস্থাও ভরসা জোগায়নি এলাকার গ্রামছাড়া পরিবারগুলিকে।


প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাধা পেলেন বাসিন্দারাও। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

বরং প্রতিনিধি দলকে সন্ত্রাস কবলিত গ্রামের পরিস্থিতি দেখাতে আশপাশের এলাকা থেকে ছুটে এসেছেন ফিরোজা বিবি, ফতেমা বিবি, মুসলেমা বিবি, সফিয়া বিবি, ফজিলা বিবিরা। তাঁরা বলেন, “আমরা প্রতিনিধি দলের কাছে গ্রামের ভেতরে সুস্থ ভাবে থাকার ব্যবস্থা করার আর্জি জানাতে চাই।” পুলিশের বাধায় অবশ্য তাঁরা বেশি দূর এগোতে পারেননি। প্রতিনিধি দলকে পুলিশ গ্রেফতার করে পাড়ুই থানায় নিয়ে যেতেই ফেরার তোড়জোড় শুরু করলেন ফিরোজারাও। চাপা সুরে বলে গেলেন, “এ বার আমাদেরও ফিরতে হবে। আত্মীয়দের কাছে আছি। গ্রামে ফিরছি না। পুলিশ থাকলেও ফেরা যাবে না। আগের বার তো পুলিশ কিছুই করেনি। ফের হামলা হলে কে বাঁচাবে।” এই পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রসূতি মায়েদের নিয়ে চিন্তিত এলাকার আশা কর্মী শাকিলা বিবি, কারিবা বিবি, আজিজা বিবিরা।

হঠাত্‌ করেই জনসংখ্যা কমে গিয়েছে মাখড়া গ্রামে। গ্রামে যে সাড়ে তিনশো পরিবারের বাস, এ দিনও তা বোঝা যায়নি। মেরেকেটে শ’দেড়েক বাসিন্দাকে গ্রামে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। গ্রামের দক্ষিণপাড়া ভাগ করে যাওয়া ময়ূরাক্ষী সেচখালের উপর দাঁড়িয়ে উত্তরপাড়ার বাসিন্দা শেখ হাবল বলছিলেন, “আপনারা যত ক্ষণ থাকবেন, তত ক্ষণ ওদের দেখতে পাবেন। সন্ধ্যা নামলে কে কোথায় আশ্রয় নেব, তার চিন্তাতেই লেগে থাকতে হয়।” আবার ক্যানালপাড়ার শেখ রকিব, মোড়ল পাড়ার শেখ মহসিন, মাঝপাড়ার শেখ জয়নালরা বলেন, “পুলিশ ক্যাম্প হয়েছে। ঘোরাফেরা করছে গ্রামে। কিন্তু মানুষ ফিরতে পারছেন না। আতঙ্কের চেহারাটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।” আতঙ্কেই থাকছেন না গ্রামের মসজিদ পাড়ার ইমামও।

এ দিন উত্তরপাড়ায় রেকশোনা বিবির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে আট বাড়ির রান্নাবান্না হচ্ছে। কেন? তিনি বলেন, “স্রেফ ভয়ে। এই আতঙ্কের পরিবেশে প্রতিবেশীরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে রান্নাবান্না করে খাচ্ছেন।” এই ভয়ের আবহেই নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত গ্রামের স্কুলপড়ুয়া শেখ মুস্তফা, শেখ বাবুরা। তারা দ্রুত স্কুলে ফিরতে চায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্কুল খুলে বসে থাকলেও একটি ছাত্র আসেনি মাখড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওখানেই পুলিশ ক্যাম্প বসেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, পাশের চৌমণ্ডলপুরের বাসিন্দা শেখ ফজলুল হক বলছেন, “আমরা শিক্ষকরা নিয়মিত আসছি। কিন্তু ছাত্রেরা মনে হয় এখনও স্কুলে আসার ভরসা পাচ্ছে না।”

বোলপুরের সিআই চন্দ্রশেখর দাসের অবশ্য দাবি, আসতে আসতে স্বাভাবিক হচ্ছে গ্রাম। এই সঙ্কটের দিন মিলিয়ে দিয়েছে গ্রামে দুই নিহতের পরিবারকে। নিহত তৌসিফ আর মোজাম্মেল, দু’জনের পরিবারেরই করুণ আর্তি, “যা হারিয়েছি, তা হারিয়েছি। আর নয়। আমরা শান্তি চাই। স্বাভাবিক গ্রামকে ফিরে পেতে চাই।”


পাড়ুইয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যদের ঢুকতে না দেওয়া এবং

গ্রেফতারের প্রতিবাদে অবরোধ সিউড়ির রাস্তায়। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE