Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
কেয়া বাত, ‘বাচ্চা’ মেয়ে!

কর্তব্যের মাসুল, মমতার কাঠগড়ায় সেই কনস্টেবল

শুক্রবার রাতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আইন রক্ষা করেছিলেন তিনি। মঙ্গলবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সেই তাঁকেই ভিলেন বানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় জিরো আওয়ারে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া জানতে চান, রাজ্যে পুলিশের উপর একের পর এক আক্রমণ চলছে। পুলিশের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী? বাম বিধায়কেরা সভা থেকে তত ক্ষণে ওয়াকআউট করে চলে গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হাত তুলে স্পিকারকে জানালেন, তিনি জবাব দিতে চান।

নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০৩:৫৬
Share: Save:

শুক্রবার রাতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আইন রক্ষা করেছিলেন তিনি। মঙ্গলবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সেই তাঁকেই ভিলেন বানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।
মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় জিরো আওয়ারে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া জানতে চান, রাজ্যে পুলিশের উপর একের পর এক আক্রমণ চলছে। পুলিশের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী?
বাম বিধায়কেরা সভা থেকে তত ক্ষণে ওয়াকআউট করে চলে গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হাত তুলে স্পিকারকে জানালেন, তিনি জবাব দিতে চান। এর পরেই তিনি মেয়রের ভাইঝির গাড়ি আটকানোর ঘটনাটি সম্পর্কে বলে ওঠেন, ‘‘বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ তার জন্য লাইসেন্স কেড়ে নেবে? হস্তক্ষেপ করছি না। কাউন্সেলিং দরকার।’’ এতেই শেষ নয়। মুখ্যমন্ত্রী আরও বললেন, ‘‘পুলিশের মধ্যে একাংশ ঠিক কাজ করেন না। তার জন্য এ সবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’’
অর্থাৎ? ঠিক যে রকম ভাবে এ রাজ্যে বিভিন্ন সময় একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনাকে কখনও ছোট্ট ঘটনা, কখনও সাজানো ঘটনা, কখনও ছোট ছেলেমেয়েদের কাজ বলে বর্ণনা করে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী, মেয়রের ভাইঝি-র ঘটনাও সেই তালিকাতেই ঢুকে গেল। রাজ্য জুড়ে শাসক দলের দাপাদাপিতে যে ভাবে লাগাতার নিগৃহীত হয়ে চলেছে পুলিশ, তাতেও কার্যত ইন্ধন পড়ল বলেই অভিযোগ বিরোধীদের। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বললেন, ‘‘উনি যে বক্তৃতা করলেন, সেটাই তো হস্তক্ষেপ। পুলিশের তদন্তের দরকার কী? উনি তো সার্টিফিকেট দিয়েই দিয়েছেন।’’ বাচ্চা মেয়েদের লাইসেন্স হয় কি, প্রশ্ন সূর্যের। আর মানস ভুঁইয়ার মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে পুলিশ আর কী কাজ করবে!’’

মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য এমন একটা সময়ে এল, যখন রাজ্য জুড়ে বারবারই কর্তব্য পালনে বাধা পাচ্ছে পুলিশ। তাদের নিগ্রহের মুখে পড়তে হচ্ছে, শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। অথচ প্রশাসনের তা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল শাসক দলের দিকেই। কখনও টেবিলের তলায় লুকিয়ে আত্মরক্ষা করতে হচ্ছে পুলিশকে (আলিপুর), কখনও থানায় ঢুকে চলছে অবাধ ভাঙচুর (বোলপুর, গড়ফা, আলিপুর) আবার কখনও বোমা-গুলি খেয়ে পুলিশই লুটিয়ে পড়ছে রাস্তায় (দুবরাজপুর, গিরিশ পার্ক)। শুধু মে মাসেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশকে নিগ্রহের ১০টি ঘটনা ঘটেছে। এই সপ্তাহের প্রথম দু’দিনের মধ্যেও এ রকম তিনটি ঘটনা ঘটেছে। কখনও মন্ত্রী জুতো পরার জন্য পা এগিয়ে দিচ্ছেন, কখনও বেআইনি হকার তুলতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে আরপিএফ। সোমবার গভীর রাতে সাঁতরাগাছি থানায় হামলা চলেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথায় এ সব নিয়ে তেমন উদ্বেগ বা ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস নেই। মালদহে আরপিএফের সঙ্গে হকারদের সংঘর্ষের ঘটনাকে তিনি ‘দুঃখজনক’ বললেও অভিযুক্তদের ধরায় তৎপরতা চোখে পড়েনি।
এই পরিস্থিতিতে ‘বাচ্চা মেয়ে’র ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব জানার পরে শুক্রবার রাতের ঘটনা নিয়েও লালবাজারে উলটপুরাণ! কর্তব্যরত ট্রাফিক কনস্টেবল চন্দন পান্ডের বিরুদ্ধেই এখন বিভাগীয় তদন্ত শুরু করার কথা ভাবছে লালবাজার।

চন্দন পান্ডের অপরাধ?

সোমবার পর্যন্ত লালবাজারের কর্তারা জানিয়েছেন, ওই কনস্টেবল নিজের কাজই করেছেন। ‘মেয়রের ভাইঝি’ শোনার পরেও চন্দনবাবু যে দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়কে ছেড়ে দেননি, তার জন্য এত দিন প্রশংসাই পাওনা হয়েছে তাঁর। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার পর থেকে কর্তাদের মুখে কুলুপ। মমতা রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীও। ফলে যে পুলিশ কর্তারা গত দু’দিন ধরে ওই কনস্টেবলের পাশে থেকেছেন, এখন তাঁরাই বলছেন, ‘‘উনি (চন্দন পান্ডে) কোনও গাড়িকে থামাতে পারেন না। চালকের লাইসেন্সও বাজেয়াপ্ত করতে পারেন না। লাইসেন্স নিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা শুধু অফিসারদেরই আছে।’’ এই যুক্তিতেই চন্দনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের কথা ভাবা হচ্ছে বলে পুলিশের একটি সূত্রের খবর। গার্ডেনরিচে এসআই তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরতে সক্রিয় হওয়ায় পদ খোয়াতে হয়েছিল তৎকালীন সিপি আর কে পচনন্দাকে। আর কনস্টেবল চন্দন রুখে দাঁড়ান মেয়রের ভাইঝির বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ‘বাচ্চা মেয়ে’ বলে তাঁকে সার্টিফিকেট দেওয়ার পরে পুলিশ কর্তারাও যে কার্যত নিরুপায়, ঘনিষ্ঠ মহলে সে কথা স্বীকার করছেন নিজেরাই!

কিন্তু টালিগঞ্জ ট্রাফিক গার্ডের ওই কনস্টেবলের সহকর্মীরা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। ঠাকুরপুকুর ট্রাফিক গার্ডের এক কনস্টেবলের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার রাস্তায় নেমে খোঁজ নিয়ে দেখুন রোদে-জলে ডিউটি কারা করে? কলকাতা ট্রাফিক পুলিশে লোক কম। তাই শুধু কনস্টেবল কেন, হোমগার্ডদের দিয়েও গাড়ি থামানো হয়, লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করানো হয়।’’ দক্ষিণ বিভাগের একটি ট্রাফিক গার্ডের এক কনস্টেবলের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যদি কোনও কনস্টেবলের কর্তব্যপরায়ণতাকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করেন, তা হলে এর পর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করব কী করে?’’

কী ভাবে মেয়রের ভাইঝি ও সঙ্গীরা তাঁকে হেনস্থা করেছেন, তার পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ শনিবার দিয়েছিলেন চন্দনবাবু। কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের প্রাথমিক তদন্তও বলছে, শুক্রবার সিগন্যাল অমান্য করে এক জন পথচারীকে ধাক্কা মারার পরেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়ের গাড়িটি আটকে ছিলেন কনস্টেবল। তার পরে ওই তরুণী এবং তাঁর সঙ্গীরা চন্দনবাবুকে রীতিমতো হেনস্থা করেন বলে অভিযোগ। কী ভাবে তাঁর জামার পকেট ধরে টানাটানি করা হয়েছিল, কী ভাবে পকেট থেকে নোটবই তুলে নিয়ে ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, কী ভাবে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ জন তরুণ-তরুণী তাঁকে অশ্রাব্য গালাগাল দিয়েছিলেন— তা পরে জানিয়েছিলেন ওই কনস্টেবল। সোমবার তিনি ছুটিতে তাঁর দেশের বাড়ি বিহারে চলে গিয়েছেন। তাঁর মোবাইলে এ দিন বারবার ফোন করেও সাড়া মেলেনি। দেবপ্রিয়া এবং তাঁর বন্ধুদের সঙ্গেও অনেক চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।

পুলিশের নিচু তলা বলছে, ওই দিন রাতে মেয়রের ভাইঝি এবং তাঁর চার সঙ্গী যা করেছেন, তাতে তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্তত পাঁচটি ধারায় মামলা করতে পারত পুলিশ। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, পথচারীকে ধাক্কা দেওয়া, কর্তব্যরত ট্রাফিক কনস্টেবলের উপরে চড়াও, কাজে বাধা দেওয়া এবং এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগ আনা যেতে পারত। পুলিশ সূত্রের খবর, টালিগঞ্জ থানারও এগুলো অজানা ছিল না। কিন্তু যে ভাবে প্রভাবশালীর ফোনে দেবপ্রিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের ওই দিন রাতেই ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়, তার পরে থানা আর এ নিয়ে এগোতে চায়নি। এক সাব-ইনস্পেক্টর স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে যে অভিযোগ করেন, তাতে প্রথম চারটি অভিযোগের উল্লেখই ছিল না বলে প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মীরা জানিয়েছেন।

কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) ভি সলোমন নেসা কুমার ঘটনার পরে ওই ট্রাফিক গার্ডে তদন্ত গিয়েছিলেন। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের পরে তিনিও মন্তব্য করতে চাননি। ওই কনস্টেবল সিপিএম সমর্থক বলে তৃণমূলের একটি অংশ থেকে প্রচার করা হচ্ছে। তবে শুক্রবার রাতে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেখানকার তৃণমূল কর্মীদের একটি বড় অংশ কনস্টেবলের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, মেয়রের ভাইঝি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না, অযথা উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। পুলিশের নিচু তলার দাবি, উপরওয়ালাদের হস্তক্ষেপেই ওই রাতে মেয়রের ভাইঝি ও তাঁর সঙ্গীদের ‘ব্রিদিং অ্যানালাইজার’ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়নি। ওই পরীক্ষা হলেই মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

লালবাজার সূত্রের খবর, আগেও দেবপ্রিয়া একাধিক বার ট্রাফিক আইন ভেঙে পার পেয়েছেন। কলকাতা পুরভোটের মুখে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে তাঁর গাড়ি আটকেছিলেন হেড কোয়ার্টার ট্রাফিক গার্ডের এক সার্জেন্ট। সে বারও দেবপ্রিয়া মেয়রের ভাইঝি বলে পরিচয় দিয়ে ছাড় পান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE