Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সেনাকে মাঝে রেখে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার লড়াই

ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য তথ্য জোগাড়ের সমীক্ষা। পাকেচক্রে হয়ে দাঁড়াল জোরদার ঠান্ডা লড়াই। রণাঙ্গনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনাম ভারতীয় সেনা। কার্যত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই। বৃহস্পতিবার বিকেলে শুরু হয়ে যেটা শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে দিল্লি পর্যন্ত গড়াল। সংসদের দুই কক্ষে চেঁচামেচি হল বিস্তর। আর টানা ৩০ ঘণ্টা ১১ মিনিট নবান্নে ঘাঁটি গেড়ে থেকে এ দিন সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় বাড়ি ফিরলেন মমতা।

শুক্রবার নবান্নে সাংবাদিকদের সামনে মুখ্যমন্ত্রী।— নিজস্ব চিত্র

শুক্রবার নবান্নে সাংবাদিকদের সামনে মুখ্যমন্ত্রী।— নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:৪৮
Share: Save:

ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য তথ্য জোগাড়ের সমীক্ষা। পাকেচক্রে হয়ে দাঁড়াল জোরদার ঠান্ডা লড়াই। রণাঙ্গনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনাম ভারতীয় সেনা। কার্যত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই। বৃহস্পতিবার বিকেলে শুরু হয়ে যেটা শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে দিল্লি পর্যন্ত গড়াল। সংসদের দুই কক্ষে চেঁচামেচি হল বিস্তর। আর টানা ৩০ ঘণ্টা ১১ মিনিট নবান্নে ঘাঁটি গেড়ে থেকে এ দিন সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় বাড়ি ফিরলেন মমতা।

যুদ্ধ পরিস্থিতি বা জাতীয় বিপর্যয় হলে সেনা ছাউনির আশপাশ থেকে খুব কম সময়ে কত পণ্যবাহী গাড়ি জোগাড় করা যায় জানতে, বছরে এক বার সমীক্ষা চালায় সেনা। সেই লক্ষ্যে নবান্নর সামনে টোলপ্লাজা-সহ রাজ্যের ১৯টি জায়গায় ১ ডিসেম্বর সেনা মোতায়েন হয়। তাদের দাবি, মহড়ার কথা আগে জানানো হয়েছিল পুলিশ ও প্রশাসনকে। তার পরেও রাজ্যের এমন প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।

রাজ্য

• রাজ্যের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ। কাবু করার চেষ্টা।

• সেনার চিঠি এলে ২৫ নভেম্বর পাল্টা চিঠি রাজ্যের।

• নবান্নের সামনে তথ্য সংগ্রহ নিয়ে লিখিত আপত্তি।

• সেনা জওয়ানেরা ঘুষ নিচ্ছিলেন।

• শুধু পশ্চিমবঙ্গেই সমীক্ষা হয়েছে।

• নবান্নের আপত্তি, টোলপ্লাজা থেকে সেনা সরে।

সেনা

• প্রতি বছর রাজ্যকে জানিয়েই সমীক্ষা।

• ২৬ নভেম্বর কলকাতা পুলিশকে ফের চিঠি।

• ২৭ নভেম্বর টোলপ্লাজায় পুলিশ-সেনা যৌথ পরিদর্শন।

• ভিত্তিহীন, নিন্দনীয় অভিযোগ। প্রমাণ দেওয়া হোক।

• বিহার-ঝাড়খণ্ডে ২৬ সেপ্টেম্বর-১ অক্টোবর সমীক্ষা।

• সমীক্ষা শেষ করেই টোলপ্লাজা ছাড়া হয়।


সেনার এই দাবি অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবারই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘সেনাবাহিনী মিথ্যাবাদী। রাজ্যের সঙ্গে তাদের কোনও কথাই হয়নি।’’ পাশাপাশি সেনার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও তোলেন তিনি। এ রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত জিওসি (বেঙ্গল এরিয়া) মেজর জেনারেল সুনীল যাদব এ দিন তার জবাবে বলেন, ‘‘ভিত্তিহীন, নিন্দনীয় অভিযোগ। এমনটা কেউ বলে থাকলে প্রমাণ দিক।’’ তাঁরও দাবি, ‘‘রুটিন সমীক্ষার কাজ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানিয়েই হয়েছে।’’ সংসদে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের মন্তব্য, ‘‘যে ভাবে এক মুখ্যমন্ত্রী ভারতীয় সেনা সম্পর্কে মন্তব্য করছেন, তাতে আমি ব্যথিত।’’

বিষয়টা ক্রমাগত সেনার বিরুদ্ধে জেহাদ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে দেখে আসরে নামে তৃণমূল। সন্ধেয় রাজ্যসভা সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন পরপর টুইট করে বলতে থাকেন, যুদ্ধটা সেনার সঙ্গে নয়, ‘স্বৈরাচারী’ কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। সেনার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা অটুট। তা হলে সেনার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ কেন উঠল, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।

তার আগেই অবশ্য দিনভর মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি আক্রমণ শানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে। বলেন, ‘‘এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দিশাহীন, দাম্ভিক সরকার আগে দেখিনি। ওরা রাজনৈতিক স্বার্থপূরণে সেনাকে ব্যবহার করছে।’’

মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব এ দিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্রীকর। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রথমে এই মহড়া ২৮,২৯ ও ৩০ নভেম্বর হওয়ার কথা ছিল। রাজ্য পুলিশের পরামর্শেই তা ১ ও ২ ডিসেম্বরে বদল করা হয়েছে। যানজট এড়িয়ে সমীক্ষা চালাতে পুলিশের সঙ্গে যৌথ পরিদর্শনও করা হয়েছে।’’ মন্ত্রী আরও জানান, গত বছরও ১৯-২১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে এই সমীক্ষা হয়েছিল। ইস্টার্ন কম্যান্ডের অধীন অসম, অরুণাচলেও সমীক্ষা চলছে। সেন্ট্রাল কম্যান্ডের অধীন উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহারেও সমীক্ষা হয়েছে। কিন্তু লোকসভায় তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, ‘‘রাজ্যকে না জানিয়ে যে ভাবে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত।’’ তা শুনে পর্রীকর বলেন, ‘‘আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে সেনার এই রুটিন মহড়া নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।’’

সেনাবাহিনীর দাবি, কলকাতা ও হাওড়া পুলিশ, পরিবহণ সচিব এবং হাওড়ার জেলাশাসক মহড়ার কথা জানতেন। তবে কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (৩) সুপ্রতিম সরকার অবশ্য দাবি করেছেন, ২৫ নভেম্বর তাঁরা চিঠি দিয়ে নবান্নর টোলপ্লাজায় অনুশীলন করতে নিষেধ করেছিলেন। নবান্ন ‘হাই সিকিওরিটি জোন’। সেখানে যানজট হতে পারে। এর উত্তরে সেনা আবার ২৬ নভেম্বর সুপ্রতিমবাবুকে পাঠানো আর একটি চিঠি সামনে এনেছে। তাতে সেনার পক্ষ থেকে পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নবান্নে অনুশীলন করলে যানজট হবে না। ওই এলাকা পূর্বাঞ্চল সেনা সদরের কাছে, তাই সমীক্ষার স্থান বদল সম্ভব নয়। এর পরে ২৭ নভেম্বর পুলিশ ও সেনা যৌথ ভাবে টোলপ্লাজা পরিদর্শন করে কাজের জায়গা নির্দিষ্ট করে। সেনার দাবি, সে দিন পুলিশ আপত্তি জানায়নি।

নবান্নের ৩০ ঘণ্টা ১১ মিনিট

শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর

সকাল পৌনে ১০টা- নবান্নে এলেন স্বরাষ্ট্রসচিব

বেলা ১১টা- মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি-কে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক

দুপুর ১২টা ৫৩- নবান্নে পৌঁছলেন কলকাতার সিপি

১টা- মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি ও সিপি-কে নিয়ে ফের বৈঠক

সাড়ে ৩টে- সাত মন্ত্রী ঢুকলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে

সন্ধ্যা ৬টা- সাংবাদিক বৈঠক করে ফের সেনা সরানোর দাবি মুখ্যমন্ত্রীর

সওয়া ৬টা- নবান্ন ছাড়লেন মুখ্যমন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর

দুপুর ১২টা ০৪- নবান্নে ঢুকলেন মুখ্যমন্ত্রী

বিকেল সাড়ে ৪টে- টোল প্লাজায় সেনা মোতায়েনের খবর এল

সাড়ে ৫টা- সাংবাদিক বৈঠকে সেনা মোতায়েনের প্রতিবাদ

রাত ৮টা ২০- মুখ্যসচিব নবান্ন থেকে বেরিয়ে গেলেন

৮টা ২৩- জরুরি তলবে ফের নবান্নে মুখ্যসচিব

৯টা- মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, সেনা না সরা পর্যন্ত নবান্নেই থাকবেন

২টো- নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী আর মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস

সেনার বয়ান শুনে পুলিশের কিছু সূত্র দাবি করছে, গত বছর মহড়ার সময় যানজট হয়েছিল। সেই সমস্যার কথা মৌখিক ভাবে এ বার সেনাকর্তাদের জানানো হয়েছিল। তবে ২৬ নভেম্বর সেনা পাল্টা চিঠি দেওয়ার পর আর কথা বাড়ানো হয়নি। যৌথ পরিদর্শনে আপত্তি জানানো হয়েছিল কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট জবাব মেলেনি। লালবাজারের এক পদস্থ অফিসার বলেন, ‘‘আমরা ঠিক করেছিলাম, সেনাকে লিখিত অনুমতিও দেব না, আবার বাধাও দেব না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর নজরে বিষয়টি আসার পরে পরিস্থিতি যে এতটা ঘোরালো হবে, তা লালবাজারের কর্তারা বুঝতে পারেননি।

পুলিশ সূত্রের দাবি, বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজস্ব সূত্রে সেনা মহড়ার খবর পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী রেগে যান। কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে ডেকে পাঠান নবান্নে। নবান্নের দাবি, রাজ্যের আপত্তির পরে মাঝরাতে টোলপ্লাজা থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করে সেনা। যদিও ভারপ্রাপ্ত জিওসি (বেঙ্গল এরিয়া) এ দিন দাবি করেন, তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হওয়ার পরেই সেনা জওয়ানদের সরানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Deployment Narendra Modi Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE