শুভেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়
ভোট আর নোট।
ছোট্ট দুটি শব্দের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা যায় গোটা বছর। বাদবাকি যা, তা না ঘটলেও বছরটা হয়তো এমনই থাকত। সেই সর্বব্যাপী খরা। সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি— সর্বত্র অচলায়তনের ভিত পোক্ত হওয়ার চিরাচরিত উপাখ্যান।
২০১৬ শুরু হয়েছিল রাজ্যে ভোটের দামামা বাজিয়ে। প্রথম ছ’মাস তাতেই পার। শেষেও দামামা— নোট-যুদ্ধের। এবং দু’টি ক্ষেত্রেই মধ্যমণি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের ভোটে মমতা কেন্দ্রীয় চরিত্র হবেন, তাতে অভিনবত্ব কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টি উল্লেখযোগ্য হওয়ার কারণ, তৃণমূল নেত্রী আক্ষরিক অর্থেই তাঁর একার জোরে ‘মানুষের জোট’কে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থেকে গেলেন। নির্বাচন পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-কে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কংগ্রেসও ধুঁকছে। ‘মানুষের জোট’ এখন রকের আড্ডায় ঠাট্টার উপকরণ। রাজ্য-রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনও একটি দলের (বলা ভাল, একটি মুখের) এতটা আধিপত্য দৃষ্টান্ত তৈরি করলেও গণতন্ত্রের সুস্থতার পক্ষে এমন পরিস্থিতি কতদূর বাঞ্ছনীয়? ২০১৬ সেই প্রশ্নটাও রেখে যায়। নতুন বছরে পা দিতে দিতে বিরোধীরাও একটু পিছু ফিরে ভাবতে পারেন, কেন তাঁদের এই পরিণতি? শুধুই সন্ত্রাস আর ভোট-জালিয়াতির ধামায় বাস্তব চাপা পড়ে কি?
নোট-বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে দিল্লির মঞ্চে মমতা এ বার যে ভাবে দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা শুরু করেছেন, সেটাও লক্ষণীয়। নরেন্দ্র মোদীর বিপক্ষে এই আন্দোলন কতটা দানা বাঁধবে, ২০১৯-র লোকসভা ভোট পর্যন্ত এই সংগ্রাম কত দূর জারি থাকবে, ময়দানে শেষ অবধি কারা কী ভাবে টিকে থাকবেন, সে সব বোঝার সময় এখনও আসেনি। তবে প্রায় সর্বত্রই পিছিয়ে পড়াদের দলে প্রথম সারিতে বসতে বাঙালি যখন ক্রমশ অভ্যস্ত হতে শিখছে, তখন বাঙালি নেত্রীর এই ভূমিকা নজর এড়ায় না।
নজর কেড়ে বাঙালির মান বাড়িয়েছেন আরও এক কন্যা। খেলার মাঠে। অল্পের জন্য পদক হাতছাড়া হয়েছে তাঁর। তবু ত্রিপুরার দীপা কর্মকার এই বছর রিও অলিম্পিকের জিমন্যাস্টিক্সে প্রোদুনোভা ভল্টের কৃতিত্বে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। ২০১৬ তাঁর জন্য জাগিয়ে দিয়েছে আগামীর উজ্জ্বলতর সম্ভাবনা।
বাঙালি স্বপ্ন দেখে। অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন। নাসা থেকে স্কলারশিপ পাওয়ার স্বপ্ন। ক’দিন আগে এ রাজ্যের এক কিশোরীও দেখেছিল। স্বপ্নই প্রমাণ হয়েছে তা। তবু এগিয়ে যাওয়ার এই রকম ইচ্ছেগুলো বাঁচিয়ে রাখলে একদিন যে সত্যিকারের সাফল্য আসবে না, কে বলতে পারে! কোনও মহৎ স্বপ্নকেই হারতে দেওয়া ঠিক নয়।
আপাতত বাঙালির সাফল্য মূলত অতীত আখ্যান। বাঙালি স্বভাবেও অতীতচারী। তাই হয়তো প্রাক্তনদের নিয়ে ওঠা-বসায় স্বচ্ছন্দ! বাংলা সিনেমার মন্দা বাজারে সাড়ে আট কোটির ব্যবসা করে ফেলেছে ‘প্রাক্তন’। গত বছর ‘বেলাশেষে’র পরে এ বছর সেই পরিচালক জুটি নন্দিতা-শিবপ্রসাদের ছবির আরও এক সাফল্য টলিউডে কিছুটা আশার আলো ফেলেছে। কিন্তু তাতে নতুন প্রতিভা উঠে না আসার আক্ষেপে তো প্রলেপ পড়ে না। কোথায় নতুন মুখ, কোথায় নতুন সম্ভাবনার উদ্ভাস? সেই সৌমিত্র-সাবিত্রী-প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণাদের নিয়ে চেনা বৃত্তে অবিরত ঘুরপাক! ঠিক যেমন বক্স অফিসে দাগ কাটতে এই বছরেও ব্যোমকেশ-ফেলুদা-কিরীটীকেই আঁকড়ে রাখল টালিগঞ্জ। ‘কামব্যাক’-এর তকমা এঁটে ফের ফেলুদা হলেন প্রৌঢ় সব্যসাচী। নজরের তালিকায় উল্লেখ থাক দুই বাঙালির এক বলিউডি ছবি— অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী পরিচালিত সুজিত সরকারের ‘পিঙ্ক’।
চলচ্চিত্রের পরে মঞ্চ। আলো সেখানেও যথেষ্ট ম্রিয়মান। যেটুকু পড়েছে তা অতীতের মুখেই। উদাহরণ: দুই যুগের দুই নাট্যব্যক্তিত্বকে নিয়ে দু’টি প্রযোজনা। গিরিশ ঘোষের জীবনভিত্তিক ‘এক মঞ্চ, এক জীবন’ এবং ‘বারবধূ’খ্যাত অসীম চক্রবর্তীকে নিয়ে তৈরি ‘অদ্য শেষ রজনী’। ইতিহাস এবং ভক্তির মিশেলে গিরিশচন্দ্রের জীবনের নানা খণ্ডচিত্র অবশ্য বিভিন্ন ভাবে লোকের সামনে আগেও এসেছে। সেই তুলনায় বিতর্কিত নাট্যপরিচালক অসীমকে নিয়ে ব্রাত্য বসুর পূর্ণাঙ্গ নাটকের ভাবনায় চমক আরও বেশি।
সাহিত্যের অঙ্গনে বাঙালির সরস্বতী এ বারেও কৃপণ। তবু বর্ষশেষে এক ঝলক খুশির হাওয়া অশীতিপর শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্তি। দেরি হল কি? প্রশ্নটা জিইয়ে রেখে এটুকু বলে রাখা ভাল, মহাশ্বেতা দেবীর পরে গত কুড়ি বছরে অন্য কোনও বাঙালি লেখক বা কবি এই পুরস্কার পাননি। ঘটনাচক্রে ২০১৬ মহাশ্বেতার প্রয়াণেরও বছর।
সাহিত্যের মতো বিজ্ঞানেরও একটি শাখায় বহু বছর পরে স্বীকৃত হলেন এক বাঙালি গবেষক। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির জীববিজ্ঞানী শুভেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জীবকোষের মাইক্রো আর এন এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন এই বছর। জীববিজ্ঞানে ১৬ বছর আগে এই সম্মান পেয়েছিলেন সিদ্ধার্থ রায়। রাসায়নিকের ক্ষুদ্রাণু বিষয়ক গবেষণার জন্যও এ বার ভাটনগর পুরস্কার এসেছে আর এক বাঙালির কাছে। তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়।
সারস্বত সাধনার ক্ষেত্রে নিজেদের চলার পথ ‘মসৃণ’ করতে রাজ্য সরকার অবশ্য এই বছর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে গিয়েছিল। বিরোধীদের আপত্তি এবং নানা মহলের সমালোচনা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধিকারকে মোটামুটি নস্যাৎ করার সব রকম বন্দোবস্ত পাকা করে বিধানসভায় বিল আনার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে একেবারে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। অনেকের মতে, ২০১৬-র এই মমতা আগের চেয়ে বেশি সতর্ক, সংযমী এবং সহনশীল। রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে যা দরকারি। উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।
ঐতিহ্যের শিক্ষাঙ্গন প্রেসিডেন্সি কলেজের (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) দু’শো বছর পূর্তি উৎসব শুরু হতে চলেছে এ বার। অতীতচারণার সগর্ব আয়োজন সেখানেও।
দু’শো না হোক, অন্তত একশো বছরের এক চলমান ইতিহাসকে এত দিন ছুঁতে পারত বাঙালি। ব্যায়ামবীর মনোহর আইচের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তারও অবসান হল।
স্মৃতিটুকু থাক। স্বাগত ২০১৭।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy