Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কৃষিপণ্যে লগ্নি টানতে বিল, সঙ্গী ধোঁয়াশাও

ক্ষমতায় আসার সাড়ে তিন বছর পর বেসরকারি লগ্নিকারীদের সামনে কৃষিপণ্যের বাজার খুলে দিতে রাজি হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আজ, বৃহস্পতিবার বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপণ্য বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী আইন পেশ করতে চলেছে সরকার। যার মোদ্দা কথা, কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে সংস্কার এনে বেসরকারি লগ্নিকে উত্‌সাহিত করা। বুধবারই এ সংক্রান্ত বিলের প্রতিলিপি বিধায়কদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

ক্ষমতায় আসার সাড়ে তিন বছর পর বেসরকারি লগ্নিকারীদের সামনে কৃষিপণ্যের বাজার খুলে দিতে রাজি হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আজ, বৃহস্পতিবার বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপণ্য বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী আইন পেশ করতে চলেছে সরকার। যার মোদ্দা কথা, কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে সংস্কার এনে বেসরকারি লগ্নিকে উত্‌সাহিত করা। বুধবারই এ সংক্রান্ত বিলের প্রতিলিপি বিধায়কদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। যদিও এই বিলে পরিকাঠামো তৈরির জন্য জমির প্রশ্নে সরকার নীরবই। লগ্নিকারীরা কতটা কৃষিপণ্য সংগ্রহ, মজুত ও বিক্রি করতে পারবেন, ধোঁয়াশা রয়েছে তা নিয়েও।

১৯৭২ সালে চালু হওয়া কৃষিপণ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইনের জেরে এখন রাজ্যে কৃষিপণ্যের নির্দিষ্ট বাজারগুলি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির মাধ্যমে ব্লক স্তরে কৃষিপণ্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চাষিরা তাঁদের পণ্য কৃষি-বাজারে নিয়ে এসে তা বিক্রি করেন। কৃষি বিপণন দফতরের নিয়ন্ত্রণেই সেই কাজকর্ম চলে। এই সব এলাকা থেকে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো কৃষিপণ্যের ব্যবসা করতে পারেন না।

২০০৩-এ এই ব্যবস্থা বদলাতে কেন্দ্রীয় সরকার একটি মডেল আইন তৈরি করে। সারা দেশে কৃষিপণ্যের ব্যবসায় ভারসাম্য আনা, আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্য চালু করা এবং কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে সব রাজ্যকে এই সংস্কার কর্মসূচিতে সামিল হতে বলা হয়। যে সব রাজ্য এই সংস্কারে সামিল হয়, তাদের জন্য ‘ম্যাক্রো মোড’ প্রকল্পে বিশেষ অনুদানও ঘোষণা করে কেন্দ্র।

কিন্তু তত্‌কালীন বামফ্রন্ট সরকার এই সংস্কারে রাজি হয়নি। তত্‌কালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই প্রকল্পের বিপক্ষে ছিলেন। ফলে ১১ বছর ধরে অন্য রাজ্যগুলি এর সুফল পেলেও এ রাজ্য বঞ্চিতই ছিল। অবশেষে সেই সংস্কারে রাজি হল রাজ্য। কারণ হিসেবে শাসক দলের তরফে ব্যাখ্যা না মিললেও কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা বলেন, “কৃষিপ্রধান পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য বেসরকারি বিনিয়োগ নেই। ফল, সব্জি, মাছের যথাযথ দাম পান না চাষিরা। সেই অবস্থা কাটিয়ে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই এই সংশোধনী।”

যদিও বণিকমহলের এক অংশের প্রশ্ন, বাজার ও অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য যে জমির প্রয়োজন তা সংস্থান কী ভাবে হবে? সরকারের জমি নীতি বদলের কোনও ইঙ্গিত তো এখনও পর্যন্ত নেই। তা ছাড়া সম্প্রতি আলু বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার যে রকম ভাবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছে, সেটাও লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জনের পরিপন্থী হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজ্য অবশ্য এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ঋণভারে জর্জরিত কোষাগারকে খানিকটা চাঙ্গা করা যাবে বলে আশাবাদী। ওই কৃষি বিপণন কর্তার কথায়, “কৃষিপণ্য থেকে এখন সামান্যই কর আদায় হয়। সংশোধিত আইন কাযর্কর হলে কৃষি ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিযোগ আসবে। ফলে রাজস্ব বাড়ার সম্ভাবনাও প্রবল।”

প্রস্তাবিত সংশোধনী আইনে কৃষিপণ্যের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হয়েছে। উদ্যান পালন, মত্‌স্য চাষ, মৌমাছি পালন, রেশম চাষ, প্রাণিপালন সংক্রান্ত বাণিজ্যকেও কৃষি বিপণনের মধ্যে আনা হয়েছে। এ সব পণ্যের অবাধ উত্‌পাদন, ক্রয়-বিক্রয়, প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং, আমদানি, রফতানি, গুদামজাত করা এবং পরিবহণের কাজ করতে সমবায়, সরকারি সংস্থা এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলির কোনও বাধা থাকবে না। কৃষিপণ্য বিপণনে কমিশন এজেন্ট নিয়োগও বৈধ করছে সরকার। কোনও বৃহত্‌ বেসরকারি সংস্থা যাতে কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে পণ্য কিনতে পারে, তার জন্য চালু হবে ই-ট্রেডিং। এতে বিলিং, বুকিং, কনট্রাক্টিং, দরাদরি, খবর আদানপ্রদান, তথ্য রাখার কাজও চলবে। এই কাজের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে ‘প্রাইভেট মার্কেট ইয়ার্ড’ গড়ার অনুমোদনও দেবে সরকার। তবে শুধু ধান-চাল কেনাবেচার ক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে সরকার। তাও যে সব ব্যবসায়ী বছরে ৭৫ কোটি টাকার বেশি ধান কেনেন, তাঁদের জন্য বিশেষ লাইসেন্স ফি ধার্য করবে কৃষি বিপণন দফতর।

বেসরকারি সংস্থাকে কৃষিপণ্যের কারবারে স্বাধীনতা দিলেও চাষিদের অভিযোগ থাকলে তা শোনারও বিধান থাকছে আইনে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুত্‌ বা বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতো ‘অ্যাপিলেট অথরিটি’ তৈরি হবে।

বাম আমলে কৃষি বিপণনে রিলায়্যান্সের মতো বেসরকারি সংস্থাকে ছাড় দেওয়ার চেষ্টার প্রবল বিরোধিতা করেছিল সরকারের শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। তখন তাদের হাতেই ছিল কৃষি বিপণন দফতর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে ফব-র বিদ্রোহে মুখ্য ভূমিকা ছিল রাজ্য কৃষি বিপণন পর্ষদের তত্‌কালীন চেয়ারম্যান নরেন চট্টোপাধ্যায়ের। ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নরেনবাবুর বক্তব্য, “রাজ্য সরকার যে সংশোধনী আনতে চলেছে, তাতে কৃষি বিপণনের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণটাই উঠে যাবে! কৃষি বিপণনে বড় কোনও সংস্থা তখনই উদ্যোগী হয়, যখন উত্‌পাদনে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন থাকে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আইন সংশোধনের পরে কৃষি উত্‌পাদনও বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।”

নরেনবাবুর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় যে মডেল আইনের (২০০৩) কথা বলে রাজ্য তাদের আইনে পরিবর্তন আনতে চাইছে, বাম আমলে সেই কেন্দ্রীয় আইন তাঁরাও বহু বার পর্যালোচনা করে দেখেছিলেন। সেই আইনে চুক্তি-চাষকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। যা কখনওই বামেদের নীতির সঙ্গে মেলে না। রাজ্য সরকারের নতুন বিলে চুক্তি-চাষ করা যাবে না, এমন কোনও কথা বলা হয়নি। এর ফলে ঘুরপথে চুক্তি-চাষের দরজা খোলা রাখা হচ্ছে বলেই নরেনবাবুদের আশঙ্কা। সত্যিই তেমন কিছু ঘটলে হয়তো বণিকমহল খুশি হবে। তবে বামেদের কৃষক সভা পথে নামবে। ফব বিধায়ক উদয়ন গুহের কথায়, “ম্যাকিনসে রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে বামফ্রন্ট সরকার চুক্তি-চাষ করতে চাওয়ায় বাবা (কমল গুহ) মন্ত্রী হয়েও বিদ্রোহ করেছিলেন। তাতে সরকারকে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল। এখনও তেমন চেষ্টা হলে আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, বিরোধিতা করব।”

সরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে বণিকমহল অবশ্য দ্বিধাবিভক্ত। কেভেন্টার্সের কর্ণধার ময়ঙ্ক জালান বলেন, “এই সংস্কারটা অনেক দিন ধরেই বকেয়া ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে প্রচুর সব্জি উত্‌পাদন হয়, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে লগ্নি করাটা লাভজনক। আর এর ফলে ফড়েদের দাপট থেকে রেহাই পেয়ে চাষিরাও তাঁদের পণ্যের যথাযথ দাম পাবেন।”

সরকার কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নিকে স্বাগত জানালেও রাজ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে বাস্তবে কতটা সাড়া মিলবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের। জমির প্রশ্ন তো থাকছেই। একই সঙ্গে বণিকমহল মনে করাচ্ছে, এর আগে কিষাণ মান্ডিতেও বেসরকারি লগ্নি চেয়েছিল সরকার। কিন্তু যেখানে মান্ডি হয়েছে, সেই জায়গাগুলো মূল বাজার এলাকার অনেক বাইরে। ফলে প্রায় কেউই লগ্নি করতে আগ্রহী হননি। সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের যা ভাবমূর্তি, তাতে কোনও বড় শিল্প সংস্থাই এখানে লগ্নি করতে আগ্রহী নয়। কৃষিক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে, এমন মনে করার কারণ নেই।

কংগ্রেসের এক বিধায়কের কথায়, “সরকার-ঘনিষ্ঠ কিছু শিল্পপতি যেমন পরামর্শ দিয়েছেন, সেই ভাবেই তারা চলার চেষ্টা করছে। রাজ্যের বাস্তব চিত্র তারা বিশেষ ভেবে দেখেনি!” আর কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের মন্তব্য, “যা বলার বিধানসভাতেই বলব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE