বাদুড়িয়ায় ধৃত মাওবাদী নেতা অরবিন্দ বাছাড়। ছবি: নির্মল বসু
দিনের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ায় রুদ্রপুরের বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ। গ্রেফতার হলেন মাওবাদীদের তাত্ত্বিক নেতা অরবিন্দ বাছাড়। আদতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা অরবিন্দ রবিবার ভোরে ধরা পড়লেন বাংলায়। তিনি পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশায় মাওবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গ্রেফতারি অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগে ধরা পড়ে ওড়িশার বারিপদা সেন্ট্রাল জেলে বছর চারেক ছিলেন। তার পরে গত ২৩ মে বাড়ি ফেরেন মধ্যবয়সি অরবিন্দ। ২০০৮ সালে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে একটি মাওবাদী হামলায় একাধিক ব্যক্তির প্রাণহানির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়। আবার লালগড় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বছর চারেক আগে এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, তখন অরবিন্দের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ-সহ সাতটি ধারায় একটি মামলা রুজু হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানায়। পুলিশের বক্তব্য, নয়াগ্রাম থানার ওই মামলায় অরবিন্দের বিরুদ্ধে পরোয়ানা ছিল এবং সেই সূত্রেই তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। অরবিন্দ লালগড়, গোয়ালতোড়, বেলপাহাড়ি, বিনপুর-সহ জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত যেতেন বলে পুলিশি সূত্রের খবর।
এ দিন ভোরে বাদুড়িয়ার ওসি কল্লোল ঘোষের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ওই মাওবাদী নেতার বাড়ি ঘিরে ফেলে। বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ঝাড়গ্রাম পুলিশের সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই অরবিন্দকে ধরা হয়েছে। বসিরহাট আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে ঝাড়গ্রাম আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ রাজ্যের মাওবাদী সংগঠনে অরবিন্দের পদমর্যাদা ঠিক কী ছিল, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কে এই অরবিন্দ?
মাওবাদী হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে অরবিন্দের কোনও রাখঢাক নেই। গ্রেফতারের পরে এ দিন বসিরহাট আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “কিষেণজি ছিলেন আমার মূল অনুপ্রেরণা। নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকেও অনেক কিছু শিখেছি।” অরবিন্দের সাফ কথা, ইদানীং সংগঠনের কাজে বিশেষ যুক্ত না-থাকলেও মাওবাদী নীতি-আদর্শ থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি। তদন্তকারীদের একাংশের সন্দেহ, ওড়িশার জেল থেকে বেরিয়ে উত্তর ২৪ পরগনায় ঢোকার পর থেকে তিনি গোপনে মাওবাদী সংগঠনের কাজকর্মই করে যাচ্ছিলেন।
কখনও চন্দ্রশেখর, কখনও বিজু ছদ্মনামে মাওবাদী কার্যকলাপে জড়িত অরবিন্দ আদতে উত্তরপ্রদেশের পিলিভিট জেলার মাধোডাঙার টান্ডা গ্রামের বাসিন্দা। তবে দীর্ঘদিন তিনি বাংলায় কাটিয়েছেন। অঙ্কে এমএসসি করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তী সময়ে বাদুড়িয়ার রুদ্রপুরের মাগুরখালিতে শ্বশুরবাড়ির কাছেই একতলা বাড়ি করেন। স্ত্রী ও বছর বারোর ছেলের সঙ্গে ইদানীং তিনি সেখানেই থাকতেন। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ওড়িশার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বারাসতের কয়েকটি গোপন ডেরায় কিছু দিন কাটিয়েছিলেন অরবিন্দ। পরে ফেরেন বাদুড়িয়ার বাড়িতে। গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি, ওই বাড়ি অন্যান্য মাওবাদী নেতারও অস্থায়ী আস্তানা হয়ে উঠেছিল। মাওবাদীদের এক সময়ের রাজ্য সম্পাদক, ২০০৮ সালে উত্তর ২৪ পরগনার হৃদয়পুর স্টেশনে ধৃত সৌমেন ওরফে হিমাদ্রি সেনরায়ের গোপন আশ্রয় ছিল অরবিন্দের বাড়ি। সৌমেন মাসের পর মাস ওই বাড়িতে কাটিয়েছেন।
২০০৮ সালে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের তৎকালীন সাংসদ সুদাম মারান্ডি (এখন ওই রাজ্যের মন্ত্রী)-কে লক্ষ করে হামলা চালায় মাওবাদীরা। ওই নেতা বেঁচে গেলেও তাঁর দেহরক্ষী-সহ কয়েক জন নিহত হন। সেই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন অরবিন্দ। ২০১০ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশি সূত্রের খবর, তখন অরবিন্দকে ধরার জন্য মূল অভিযান চালিয়েছিল কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। পরে তাঁকে ওড়িশা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
অরবিন্দের বক্তব্য, তিনি সংগঠনের তাত্ত্বিক দিকটির সঙ্গে যুক্ত। তিনি স্বীকার করছেন, “জঙ্গলমহল-সহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। দলের ছেলেদের মাওবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত করাই ছিল আমার কাজ। কিন্তু কখনও অস্ত্র হাতে লড়াই করিনি।” নয়াগ্রাম থানায় অরবিন্দের বিরুদ্ধে রুজু হওয়া মামলায় অবশ্য অস্ত্র-সহ জমায়েত, অগ্নিসংযোগের মতো অভিযোগ আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy