ধরমপুরে বিকাশের সেই সাংবাদিক বৈঠক। — ফাইল চিত্র।
ডান কাঁধে ঝোলানো কালাশনিকভের নল মাটির দিকে মুখ করা। ক্যামেরাধারীরা রয়েছেন পিছনে, যাতে মুখের ছবি না-ওঠে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্যামেরাহীন এক দল সাংবাদিক তাঁর কথা শুনছেন।
সাংবাদিক বৈঠক করছেন মাওবাদী নেতা বিকাশ। পশ্চাৎপট জুড়ে দাউদাউ আগুন। জ্বলছে সিপিএম পার্টি অফিস। কিছু দূরে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডের শৌখিন দোতলা অট্টালিকা।
তারিখটা ছিল ২০০৯-এর ১৬ জুন। মাওবাদী সন্ত্রাসে জঙ্গলমহল তখন তোলপাড়। লালগড়ের ধরমপুরে সে দিন এ ভাবেই প্রচারের আলোয় উঠে এসেছিল বিকাশ, যার আসল নাম মনসারাম হেমব্রম। অস্ত্রে সজ্জিত কোনও গুপ্ত সংগঠনের নেতার সাংবাদিক বৈঠক পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রথম। তার পরে কংসাবতী দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী প্রভাব কমতে কমতে কার্যত তলানিতে ঠেকেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিকাশকে ধরা যায়নি।
নতুন বছরে চল্লিশ ছুঁইছুঁই সেই জঙ্গি-নেতাকেই পাখির চোখ করেছে রাজ্যের পুলিশ-গোয়েন্দারা। মাওবাদী দমনে বিশেষ প্রশিক্ষিত ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স’ (সিআইএফ) ও রাজ্য আইবি-র অফিসারেরা কোমর বেঁধে নেমেও পড়েছেন। নবান্নের খবর: ঝাড়খণ্ড পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বিকাশকে জালে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।
ঝাড়খণ্ড কেন? গোয়েন্দাদের দাবি: বিকাশের মূল ডেরা আপাতত ওই পড়শি রাজ্যে। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার এমজিএম থানা এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে সে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলা আদায় করছে। ‘‘ও ধরা পড়লে স্বস্তি ঝাড়খণ্ডেরও ।’’— বলছেন রাজ্যের এক স্বরাষ্ট্র-কর্তা। সিআইএফের এক শীর্ষ কর্তার আশাবাদী পর্যবেক্ষণ, ‘‘এই তল্লাটে মাওবাদীদের যেটুকু এখনও টিকে আছে, বিকাশ কব্জায় এলে তা-ও মিলিয়ে যাবে।’’ কী রকম?
ওঁদের ব্যাখ্যা: পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অধরা মাওবাদী নেতাদের মধ্যে বিকাশই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গেরিলা লড়াইয়ে যেমন পারদর্শী, তেমন তার সাংগঠনিক দক্ষতা। ঝাড়খণ্ড সীমানা বরাবর এ রাজ্যের জঙ্গলমহলে যাওয়া-আসা করে যে ক’টা মাওবাদী স্কোয়াড, তার মধ্যে বিকাশেরটাই বৃহত্তম। তাতে সদস্য অন্তত ১৫ জন। প্রায় সকলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। একে ফর্টি সেভেন, ইনস্যাস জাতীয় অন্তত তিনটি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ওদের হাতে রয়েছে।
বিকাশের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে গোয়েন্দারা আরও জানাচ্ছেন, মদন মাহাতো, শ্যামল, জয়ন্ত ওরফে সাহেবরাম হেমব্রম কিংবা রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুলের মতো মাওবাদী নেতারাও এক-একটি স্কোয়াডের নেতৃত্ব দেয়। তবে সেগুলোর সদস্য সাত-আটের বেশি নয়। বিকাশের মাপের নেতাও এরা নয়। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘নতুন ভাবে সংগঠন ও স্কোয়াড গড়ার ক্ষমতা শুধু বিকাশেরই আছে। মাওবাদীদের ইস্টার্ন রিজিওনাল ব্যুরোর সদস্য হওয়ার সুবাদে ওর কাছে বিহার-ওড়িশায় দলের কার্যকলাপ সম্পর্কেও তথ্য মিলতে পারে।’’
সিআইএফ বলছে, পশ্চিম মেদিনীপুরে গোয়ালতোড়ের মেটালা গ্রামের ছেলে বিকাশ সিপিআই (মাওবাদী)-এর কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের রাজ্য শাখার প্রধান। লালগড় আন্দোলন চলাকালীন এলাকার জনপ্রিয় নেতা শশধর মাহাতোর চেয়েও সংগঠনে বিকাশকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন পার্টির শীর্ষ নেতা কিষেণজি। বস্তুত সংগঠনে কিষেণজির পরে বিকাশের নির্দেশই ছিল শেষ কথা। বিকাশ তখন সিংরাইল টুডু নামটিও ব্যবহার করত।
এবং তারই নেতৃত্বে ২০০৯-এর জুনে সিপিএমের ‘দুর্গ’ ধরমপুর দখল করে মাওবাদীরা। সেই সংঘাতের প্রতি পদে বিকাশ নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেয়। সিজুয়ার এক প্রাক্তন মাওবাদীর বর্ণনায়, ‘‘এক সকালে বিকাশদা মাঠ পেরোচ্ছে। দোনলা বন্দুক থেকে বেমক্কা গুলি চালাল সিপিএমের লোক। শব্দ শুনেই বিকাশদা ডিগবাজি খেয়ে একে ফর্টি সেভেন ফায়ার করল। গুলি গিয়ে লাগল লোকটার ঠিক কপালে!’’
এ হেন ধুরন্ধর নিশানাবাজ ‘যোদ্ধা’র নাম অবশ্য দেড় দশক আগেই উঠে গিয়েছিল গোয়েন্দা-খাতায়। ‘‘তখন আমরা বলতাম, শশা-মশা-অসা। মানে তিন মাওবাদী নেতা। শশা মানে শশধর, মশা মানে মনসারাম (অর্থাৎ বিকাশ), আর অসা হল অসিত সরকার।’’— স্মৃতিচারণা করছেন আইবি-র এক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। ত্রয়ীর মধ্যে বিকাশই শুধু জীবিত। গোয়েন্দা-তথ্য বলছে, আদিবাসী যুবকটির একটানা বহু দিন জঙ্গলে থাকার ক্ষমতা আছে, যা কি না আকাশের নেই। প্রসঙ্গত, অন্যতম ফেরার মাওবাদী নেতা আকাশ ওরফে অসীম মণ্ডল সংগঠনে বিকাশের চেয়ে অনেকটা ‘সিনিয়র।’ বয়সেও বড়।
তবু বিকাশই এখন প্রধান লক্ষ্য। ২০১২-র অগস্টে রঞ্জন মুণ্ডার পরে জঙ্গলমহলে তেমন উঁচু দরের কোনও মাওবাদী নেতা ধরা পড়েনি। এক আইবি-কর্তা বলেন, ‘‘আগে মাথাকে বাগে আনা দরকার। তার পরে অন্যদের কথা ভাবা যাবে।’’
ওঁদের তালিকায় বিকাশের পরের নামটি রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy