সরকারি হাসপাতালে ‘নির্মল অভিযান’ চলছে-চলবে! তবে সেই অভিযানে দফতর মলিনই হচ্ছে বেশি! একের পর এক ঘটনায় তা বার বার প্রমাণিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্তারা নিজেরাও তা মানেন। এরই সর্বশেষ নজির এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অর্পিতা রায়চৌধুরীর বদলি।
কুকুরের ডায়ালিসিস-কাণ্ডে তিনি রুখে দাঁড়ানোতেই এমন একটি লজ্জাজনক ঘটনার সাক্ষী হতে হতে কোনও ক্রমে বেঁচে গিয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতাল। কিন্তু সেই সময়েই ডায়ালিসিস-কাণ্ডের মূল পাণ্ডা নির্মল মাজি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি এই ‘বেয়াদপি’ সহ্য করবেন না! অর্পিতার বদলি কি তারই পরিণতি? স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই সে কথা মানতে চাননি।
কিন্তু ঘটনাক্রম সে কথাই বলছে। কী রকম? অর্পিতাকে যেখানে বদলি করা হয়েছে, সেই নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেফ্রোলজির কোনও ইনডোর ওয়ার্ড নেই! নেই পড়ুয়াও! তাই আদতে ওই হাসপাতালে এই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তেমন কোনও কাজকর্মই থাকবে না। স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশের কথায়, ‘‘এ হল অনেকটা কম্পালসারি ওয়েটিং-এর মতো। নামেই পদোন্নতি দিয়ে অন্য হাসপাতালে বদলি। আদতে চুপচাপ বসে থাকতে হবে!’’
এসএসকেএম কর্তারাও এই বদলির সিদ্ধান্তে হতবাক। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, এসএসকেএমের শীর্ষ প্রশাসক স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে এই বদলির নির্দেশ পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ জানান। কিডনি প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে কিডনির একাধিক জটিল রোগের চিকিৎসা যে এর ফলে ধাক্কা খাবে, সে কথাও জানান তাঁরা। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। এখন কিছু করা যাবে না। নির্বাচন পর্ব মিটে গেলে চেষ্টা করা যাবে।’’
এর আগে বাম জমানাতেও এমন বদলির নজির ছিল। এসএসকেএমেরই নেফ্রোলজির বিভাগীয় প্রধান অভিজিৎ তরফদারকে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে, যেখানে ওই বিভাগটিই ছিল না! প্রতিবাদে সরকারি চাকরি ছাড়েন অভিজিৎবাবু।
সাম্প্রতিক কালের মধ্যে যাঁর বদলিকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে, তিনি চিকিৎসক অরুণ সিংহ। এসএসকেএমের নিওন্যাটোলজি বিভাগের প্রধান অরুণবাবু বিবাদে জড়িয়েছিলেন মা ও শিশু মৃত্যু রোধে গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যিনি আবার সরকারের ঘনিষ্ঠ। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকেও সরতে হয়েছিল বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর। নবজাতক চিকিৎসায় যাঁর তৈরি করা মডেল গোটা দেশে তো বটেই, এমন কী অন্য একাধিক দেশেও স্বীকৃতি পেয়েছে, তাঁকেই বদলি করা হয়েছিল কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালে যেখানে ওই বিভাগটিই নেই! পরে কেন্দ্রীয় সরকার অরুণ সিংহকে রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রমের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করে। সে ক্ষেত্রেও অবশ্য ছাড়পত্র দেয়নি রাজ্য। কিন্তু তার তোয়াক্কা না করেই অরুণবাবু সেই কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
গত বছর জুন মাসে এসএসকেএমে একটি কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে উদ্যোগী হন তৃণমূল বিধায়ক, চিকিৎসক নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ নির্মল মাজি। হাসপাতালের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র এবং নেফ্রোলজির বিভাগীয় প্রধান রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে এই উদ্যোগে অনুমোদন দিলেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অর্পিতা। সেই দিন নেফ্রোলজি বিভাগে ভিজিটিং চিকিৎসক ছিলেন তিনি। নিজের নোটে অর্পিতা লেখেন, ‘‘কুকুরের মতো জন্তুর দেহ থেকে রক্তের মাধ্যমে ডায়লিসিস যন্ত্রে এমন ভাইরাস চলে আসতে পারে, যা থেকে পরে মানুষের মারাত্মক রোগে হতে পারে। আমি এর অনুমতি দিতে পারি না।’’ তাঁর এই নোট পেয়েই শেষ পর্যন্ত অনুমতি তুলে নেন হাসপাতালের অধিকর্তা। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় সমস্ত মহলে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। এই ঘটনার জেরে অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রকে সরিয়ে কম্পালসারি ওয়েটিং-এ পাঠানো হলেও সরকার-ঘনিষ্ঠ রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে এখনও স্বপদে বহাল! আর স্বাস্থ্যে ক্রমশই প্রবল হচ্ছে নির্মল-চাপ! স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, তখন থেকেই নির্মলের ‘হিটলিস্টে’ ছিলেন অর্পিতা। তড়িঘড়ি কিছু করলে ফের সমালোচনা শুরু হবে বুঝে মাস কয়েক অপেক্ষা করেছেন। তার পর ‘ঝোপ বুঝে কোপ’!
নির্মল নিজে অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই এই অভিযোগ এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। প্রশ্ন শুনেই ফোন নামিয়ে রেখেছেন তিনি। অর্পিতা রায়চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করবেন না।
স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা অংশের যুক্তি, এটা সরকারি চাকরি। তাই এখানে বদলি থাকবেই। কিন্তু এর সঙ্গে কুকুর কাণ্ডের কোনও যোগ নেই? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘এটা রুটিন বদলি। এর বাইরে এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না।’’ পাশাপাশি তাঁর যুক্তি, ‘‘এনআরএসে ভবিষ্যতে নেফ্রোলজি ওয়ার্ড খোলা হবে। তাই ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’’ কবে খোলা হবে সেই ওয়ার্ড? সেই প্রশ্নের কোনও জবাব অবশ্য তিনি দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy