Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
অনুমোদন মিললেও জানে না মেদিনীপুরের বহু স্কুল

ঘর বাড়ন্ত, একসঙ্গে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণি

শ্রেণিকক্ষ একটি। দু’দিকে দুই শ্রেণির ছাত্রছাত্রী। শিক্ষক যখন সপ্তম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা তখন পুরনো পড়ায় মন দেয়। আর শিক্ষক যখন অষ্টম শ্রেণির ক্লাস নেন সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়াদের চোখে বিস্ময়। নিজের পড়া ভুলে মন ছুটছে অন্য দিকে।

একই ঘরে চলছে দু’টি শ্রেণির পঠনপাঠন। তাঁতিগেড়িয়া হিন্দি জুনিয়র হাইস্কুলে। নিজস্ব চিত্র।

একই ঘরে চলছে দু’টি শ্রেণির পঠনপাঠন। তাঁতিগেড়িয়া হিন্দি জুনিয়র হাইস্কুলে। নিজস্ব চিত্র।

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৪৩
Share: Save:

শ্রেণিকক্ষ একটি। দু’দিকে দুই শ্রেণির ছাত্রছাত্রী।

শিক্ষক যখন সপ্তম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা তখন পুরনো পড়ায় মন দেয়। আর শিক্ষক যখন অষ্টম শ্রেণির ক্লাস নেন সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়াদের চোখে বিস্ময়। নিজের পড়া ভুলে মন ছুটছে অন্য দিকে।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আপার প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলির এমনই দশা। পর্যাপ্ত ঘর নেই যে। যে আপার প্রাইমারি শুরু হয়েছে পঞ্চম শ্রেণি দিয়ে, তা এখন অষ্টম শ্রেণিতে পা দিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ তৈরির জন্য অর্থ মেলেনি। কিছু স্কুলে একটি বা দু’টি অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সম্পূর্ণ টাকা না মেলায় ঘর সম্পূর্ণ করা যায়নি। জানালা-দরজা নেই। নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা বাধ্য হয়ে নিজেদের খরচে বিদ্যুত্‌ সংযোগ নিয়েছেন।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পে অর্থ মেলেনি। তাই যে সব স্কুল চালু হয়েছে, সেই সব স্কুলে শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা যায়নি এমন নয়, অনুমোদন হওয়া অনেক নতুন স্কুলও চালু করা যায়নি। বহু স্কুলের ছাদ থেকে জল পড়ছে, দেওয়ালে ফাটল, তাও সংস্কার করা যায়নি। সর্বশিক্ষার জেলা প্রকল্প আধিকারিক সুদীপ্ত দেবনাথ বলেন, “আমরা টাকা চেয়েছি। টাকা পেলেই স্কুলগুলিকে দেওয়া হবে।” কিন্তু কবে টাকা মিলবে সে বিষয়ে কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি তিনি।

এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, নতুন করে প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জুতো দেওয়ার ঘোষণায়। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাথমিকের প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জুতো দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন সমাবেশে গিয়ে জানাচ্ছেন, এর জন্য রাজ্য সরকার ১৫৪ কোটি টাকা খরচ করে জুতো দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।

কিন্তু যেখানে ছাত্রছাত্রীদের বসার ঘর নেই, সেখানে জুতো নিয়ে কী হবে?

এ প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর নেই প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে। ধরা যাক, মেদিনীপুর শহরের তাঁতিগেড়িয়া হিন্দি জুনিয়র হাইস্কুলের কথা। ২০১১ সালে এই স্কুল তৈরির অনুমোদন মেলে। ২০১৩ সালে ক্লাস স্কুল চালু হয়। প্রথমে পাশের প্রাথমিক স্কুলের বারান্দায় স্কুল শুরু হয়েছিল। পরে একটি ক্লাসঘর হয়। বর্তমানে দু’টি ঘর। তাও অসম্পূর্ণ।

প্রধান শিক্ষিকা অপর্ণা সাইনি বলেন, “দ্বিতীয় শ্রেণিকক্ষের ৭৫ শতাংশ অর্থ মিলেছিল। বাকি ২৫ শতাংশ মেলেনি। ফলে কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে।” শুধু তাই নয়, স্কুলের বিদ্যুত্‌ সংযোগের জন্য স্কুলের দুই শিক্ষিকাই অর্থ দিয়েছেন বলেও জানালেন। স্বাভাবিকভাবেই দু’টি ক্লাসরুমে চারটি শ্রেণির পঠনপাঠন চলে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অনুরাধা সাউ, নিশা প্রসাদেরা জানালেন, “এতে ভীষণ সমস্যা হয়। নিজেদের পড়ায় মন থাকে না।” এ রকম বহু স্কুল রয়েছে জেলায়। গোবিন্দনগর জুনিয়র হাইস্কুলে আবার একটি ক্লাসঘর। টিচার-ইনচার্জ অভিজিত্‌ দে বলেন, “বাধ্য হয়ে বারান্দাতেও ক্লাস করতে হয়। টাকা পেলে তো ঘর বানাব।”

টাকা না থাকায় জেলায় ১১৭টি নতুন স্কুলও তৈরি করা যায়নি। এক বছর হল স্কুলগুলির অনুমোদন মিলেছে। যে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আপার প্রাইমারির অনুমোদন মিলেছে, তাঁদের জানানো পর্যন্ত হয়নি। মেদিনীপুর সদর ব্লকের দেলুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় আপার প্রাইমারির অনুমোদন মিলেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাত ভট্টাচার্য তা জানেনই না। তাঁর কথায়, “আমরা বহু বছর ধরে আপার প্রাইমারির জন্য আবেদন জানিয়ে আসছি। এখানে আপার প্রাইমারি ভীষণ জরুরি। কিন্তু হয়েছে বলে কেউ জানায়নি।”

জানাবে কী করে? সর্বশিক্ষা প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার প্রায় সাড়ে ৩০০ স্কুলকে একটি করে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ তৈরির জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। প্রায় দেড়শো স্কুলকে ৭৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া গিয়েছে। বাকিদের মাত্র ২৫ শতাংশ দেওয়া গিয়েছে। বেশিরভাগ স্কুলই কাজ করে খরচের হিসাব দিয়ে পরের কিস্তির টাকা চেয়ে আবেদনও জানিয়েছেন। কিন্তু টাকা না থাকায় দেওয়া যায়নি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, তিন বছর স্কুলের সংস্কারের বরাদ্দ মেলেনি। ওই খাতে বছরে ৪-৫ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। নতুন স্কুল তৈরি করতে প্রায় ন্যুনতম ১৬ -১৮ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। যা দিয়ে স্কুল শুরু করা যায়। সব মিলিয়ে জেলায় অবিলম্বে এই খাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। অথবা নতুন আপার প্রাইমারি স্কুল যেমন তৈরি করা যাবে না, তেমনি অতিরিক্ত শ্রেণি কক্ষ তৈরি বা সংস্কার সম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE