Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শোকে একজোট মলুটি, মেয়েকে ছাড়ল নার্সিংহোম

কেউ বিপদে পড়লে গোটা গ্রাম একজোট হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। তাঁদের চেষ্টা সত্ত্বেও একটা প্রাণ অকালে চলে গেল, এই সত্যিটা মেনে নিতে পারছে না ঝাড়খণ্ডের মলুটি গ্রাম।

গ্রামের বাড়িতে চুমকির সদ্যোজাত শিশুকে সামলাতে ব্যস্ত পরিবার। শুক্রবার সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

গ্রামের বাড়িতে চুমকির সদ্যোজাত শিশুকে সামলাতে ব্যস্ত পরিবার। শুক্রবার সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
শিকারিপাড়া (ঝাড়খণ্ড) শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩
Share: Save:

কেউ বিপদে পড়লে গোটা গ্রাম একজোট হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। তাঁদের চেষ্টা সত্ত্বেও একটা প্রাণ অকালে চলে গেল, এই সত্যিটা মেনে নিতে পারছে না ঝাড়খণ্ডের মলুটি গ্রাম।

এই গ্রামেরই তপন লেটের (৪৬) ঝুলন্ত দেহ মিলেছে বুধবার। তাঁর মেয়ে চুমকি, সদ্য মা হওয়ার পরে পরেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে ভর্তি হয়েছিলেন বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমে। তপনবাবুর মেয়েকে ছাড়াতেও যথাসাধ্য টাকা তুলেছিলেন পড়শিরা। তবু তা নার্সিংহোমের বিলের অঙ্ক থেকে ছিল অনেকটাই কম। হতদরিদ্র তপনবাবু বাকি টাকা জোগাড় করে উঠতে পারেননি। অভিযোগ, সে কারণে নার্সিংহোম মেয়েকে ছাড়তে চায়নি। মানসিক চাপে নিজেকে শেষ করেছেন পেশায় চাষি তপনবাবু।

শুক্রবার ওই যেতেই যুবক পুলক চট্টোপাধ্যায় বলে উঠলেন, ‘‘দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) তো বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করছেন বলে শুনেছি। তাঁরই রাজ্যেরই এক নার্সিংহোমের অমানবিক ব্যবহারের জন্য একটা গরিব পরিবার পথে বসতে চলেছে! সংবাদমাধ্যম এই খবরটা তুলে ধরুক। দিদি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।’’

মুক্তির আগে। বর্ধমানের নার্সিংহোমে চুমকি লেট। —নিজস্ব চিত্র।

বীরভূমের গা ঘেঁষে থাকা শিকারিপাড়া থানার মলুটি গ্রাম থেকে সে রাজ্যের সব থেকে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তাই চিকিৎসা করাতে কাছে থাকা (দূরত্ব ৬ কিলোমিটার) বীরভূমের কাষ্ঠগড়ায় রামপুরহাট ১ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং রামপুরহাট জেলা হাসপাতালে (১৯ কিলোমিটার দূরে) প্রত্যন্ত গ্রাম মলুটির মতোই লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে রোগীরা ছুটে আসেন। অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই রামপুরহাট হাসপাতাল থেকে রোগীকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। মলুটির অসিতবরণ সাহা, কার্তিকচন্দ্র মণ্ডলদের ক্ষোভ, ‘‘ওই হাসপাতালেই চুমকির চিকিৎসা হলে তপনবাবুর এই পরিণতি হয়তো হতো না। গরিব লোকটাকে স্রেফ ভুল বুঝিয়ে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’’

অথচ, বর্ধমানের নার্সিংহোমে চুমকিকে ভর্তি করার জন্য প্রথমেই তপনবাবুর হাতে ২০০০ টাকা দেন পড়শি পাথর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক পতা বাগদি। একে একে অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক পার্থসারথি মণ্ডল, গ্রামের বড় চাষি ও মুদিখানা দোকানের মালিক সুবীর মণ্ডল, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মী নীরোজ ভট্টাচার্য— প্রত্যেকেই ১০০০ টাকা করে এ ভাবেই উঠেছিল ১১ হাজার টাকা। অসিতবাবুরা বললেন, ‘‘তপন মঙ্গলবার গ্রামে ফিরে যখন টাকা কী ভাবে জোগাড় করবে ভেবে মুষড়ে পড়ে, তখনই টাকা তুলতে শুরু করি।’’ বুধবারই গ্রামের কিছু লোকের সঙ্গে ওই টাকা নিয়ে তপনবাবুর বর্ধমানে যাওয়ার কথা ছিল। শোকের মধ্যেও নার্সিংহোম থেকে তাঁর মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে ফের টাকা তোলেন গ্রামবাসী। শুক্রবার সকালে বর্ধমান যাওয়ার জন্য ওই পরিবারের হাতে হাজার চারেক টাকা তুলে দেন তাঁরা। এর পরেও চিন্তা ছিল, নার্সিংহোম থেকে মেয়েটা ছাড়া পাবে তো?

চুমকিকে ছেড়ে দিয়েছে নার্সিংহোম— সন্ধ্যায় সে খবর পৌঁছতেই স্বস্তি ফেরে মলুটিতে। সঙ্গে খেদ— মেয়ের সেই বাড়ি ফেরা দেখতে পেলেন না তপন লেট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE