Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শহরের কাছেই ডাইনি অপবাদে মার, ধৃত ওঝা

জেলা সদর থেকে বড়জোর এক কিলোমিটার দূরের গ্রামে এক বিবাহিতা মহিলাকে ডাইনি অপবাদে মারধর, ওঝা ডেকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠল বর্ধমানে।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১৭
Share: Save:

জেলা সদর থেকে বড়জোর এক কিলোমিটার দূরের গ্রামে এক বিবাহিতা মহিলাকে ডাইনি অপবাদে মারধর, ওঝা ডেকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠল বর্ধমানে। গ্রামবাসীদের কুসংস্কারে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পঞ্চায়েত প্রধান ও যুগ্ম বিডিও-র বিরুদ্ধেও। ভয়ে স্বামীকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন ওই মহিলা। পরে পুলিশ বর্ধমান শহর লাগোয়া হাটশিমুল নামের ওই গ্রাম থেকে এক মহিলা ওঝা ও তার চার শাগরেদকে গ্রেফতার করে। যদিও প্রধান বা যুগ্ম বিডিও অভিযোগ মানতে চাননি।

হাটশিমুল গ্রামের কাছেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মাথা তুলছে ‘মিষ্টি বাংলা হাব’। আদিবাসী অধুষ্যিত এই গ্রামে একাধিক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, একটি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। হাঁটা দূরত্বে আছে উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। প্রশাসন সূত্রের দাবি, গ্রামে সাক্ষরতার হার ৬০ শতাংশের উপরে।

‘আক্রান্ত’ মহিলার বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। তিনি বর্ধমান শহর লাগোয়া বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী। পুলিশের কাছে করা অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, রবিবার রাতে জামালপুরের যোজনপুর থেকে মহিলা ওঝা বুদিন হেমব্রম, তার শাগরেদ রামপদ হেমব্রম, ভূতিরাম হেমব্রম, লুখিরাম হেমব্রম ও হাবল হেমব্রমকে গ্রামে ডেকে এনে তাঁর উপরে জোর-জবরদস্তি করে স্থানীয় কয়েকজন। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবিতে তাঁর বাড়িতে ঢুকে পুজো করতে চায় ওঝার দল। মহিলার দাবি, ওঝারা বলে তাঁর বাড়িতে ‘ভূত’ রয়েছে। যজ্ঞ করে ‘ভূত তাড়ানো’ হলে ওই মহিলাকে সাড়ে দশ হাজার টাকা ‘জরিমানা’ দেওয়ারও নিদান দেয় ওই মহিলা ওঝা। তবে ওঝাদের কথা মানতে চাননি ওই মহিলা। তাঁর অভিযোগ, প্রতিবাদ করতেই বীরেন হেমব্রম-সহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী ও ওঝারা তাঁকে মারতে শুরু করে। স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছনোয় প্রাণে বাঁচেন তিনি।

পুলিশের কাছে করা অভিযোগে মহিলা দাবি করেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর জামালপুরের নবগ্রামের ঝাঝিলপুরের এক ওঝার কাছে গ্রামবাসীরা তাঁকে জোর করে নিয়ে যান। সেখানে এক প্রস্ত মারধরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে। পাঁচ দিন পরে বাড়ি ফিরলে গ্রামবাসীদের একাংশ তাঁকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিতে শুরু করেন।

কেন দেওয়া হচ্ছে অপবাদ?

অভিযোগ উড়িয়ে গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, ওই মহিলার বাড়ির পাশে একটি বড় পুকুরে পরপর পাঁচ জন ডুবে মারা গিয়েছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকের ধারণা হয়, ওই মহিলা বাড়িতে এমন কোনও পুজো করেন, যার ফলে ‘খারাপ’ হচ্ছে। তাই তাঁকে পুজো বন্ধ করতে বলা হয়। ঘটনায় নাম জড়ানো স্থানীয় বাসিন্দা বীরেন হেমব্রমের দাবি, ‘‘মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দেওয়া হয়নি। এলাকায় কোনও কুপ্রভাব যাতে না থাকে, তাই যুগ্ম বিডিও এবং প্রধানের অনুমতি নিয়ে তান্ত্রিক এনে পুজো করাচ্ছিলাম। ভাবিনি, আমাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ হবে।’’ বৈকুণ্ঠপুর ২ পঞ্চায়েতের প্রধান জবা মালিক বলেন, “এক মহিলার উপরে অত্যাচার হচ্ছে শোনার পরেই আমি পুলিশকে খবর দিয়েছি। ঘটনায় আমি জড়িত নই।” জড়িত থাকার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বর্ধমান ২-এর যুগ্ম বিডিও বিদ্যুৎবরণ বিশ্বাসের বক্তব্য, “এ ব্যাপারে কিছু বলব না।”

পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ভূমিকা দেখা হচ্ছে। ওই গ্রামে সচেতনতা প্রচারে জোর দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নিশীথ মালিক এবং জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু। সভাধিপতি বলেন, “ওই গ্রামে সচেতনতা প্রচার করতে যাব। প্রধান কী করেছেন, খোঁজ নেব। যুগ্ম বিডিও-র ভূমিকা খতিয়ে দেখতে প্রশাসনকে বলব।”

ধৃত পাঁচ জনকে সোমবার বর্ধমান আদালতে হাজির করানো হলে আট দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। নিজে মহিলা হয়ে কেন এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিলেন জানতে চাওয়ায় ধৃত বুধিন হেমব্রমের জবাব, ‘‘সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Witch superstition woman lynched
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE