Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এখনও আতঙ্কের রেশ দরবারপুরে

বোমা বিস্ফোরণ-কাণ্ডে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ল বীরভূমের লাভপুরে। বালিঘাটের দখল কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে দু’দল সমাজবিরোধীর লড়াইয়ে শুক্রবার দরবারপুর গ্রামে বোমা ফেটে মারা যান আট জন।

গ্রেফতার: বোলপুর আদালতে লাভপুর-কাণ্ডে ধৃতেরা। নিজস্ব চিত্র

গ্রেফতার: বোলপুর আদালতে লাভপুর-কাণ্ডে ধৃতেরা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
লাভপুর ও বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০২:০৪
Share: Save:

বোমা বিস্ফোরণ-কাণ্ডে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ল বীরভূমের লাভপুরে।

বালিঘাটের দখল কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে দু’দল সমাজবিরোধীর লড়াইয়ে শুক্রবার দরবারপুর গ্রামে বোমা ফেটে মারা যান আট জন। আহত হন জনা চারেক। তাঁদের মধ্যে গুরুতর জখম সাবির মল্লিক (২২) শনিবার ভোরে বর্ধমান সদরের একটি নার্সিংহোমে মারা যান বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সাবিরের ভর্তি হওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাঁর মৃত্যুসংবাদ পুলিশ পায়নি। ফলে, এ দিন সকালে ময়না-তদন্ত না করিয়েই দেহ নিয়ে লাভপুরের উদ্দেশে রওনা দেন সাবিরের আত্মীয়-পরিজনেরা। পুলিশ পিছু নিয়ে বর্ধমানের হলদির কাছে সাবিরের দেহ আটকায়। ময়না-তদন্তের জন্য তা কাটোয়া হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের দাবি, সকালে সাবিরের মৃত্যুর পরে বর্ধমান থানায় ফোন করা হয়। কিন্তু যোগাযোগ করা যায়নি। তার মধ্যেই নিহতের পরিজন নার্সিংহোমে গোলমাল পাকান। দেহ নিয়েও চলে যান। নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। আর এক আহত হাসিবুর শেখকে বর্ধমান মেডিক্যাল থেকে কলকাতার এসএসকেএমে পাঠানো হয়েছে।

বীরভূমের পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, ‘‘শুক্রবারের বিস্ফোরণের ঘটনায় ছ’জনকে ধরা হয়েছে। টহল চলছে।’’ ধৃতদের মধ্যে রেজাউদ্দিন শেখ নামে এক অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ। বাকিদের জেল-হাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল শুক্রবার দাবি করেছিলেন, ঘটনার পিছনে রয়েছে সিপিএমের দুষ্কৃতীরা। এ দিন অবশ্য রামপুরহাটে তিনি বলেন, ‘‘নিহতেরা কোনও রাজনৈতিক দলের লোক নয়। ওরা বালি-মাফিয়া।’’

ময়ূরাক্ষী নদীর বালিঘাটের দখলকে কেন্দ্র করে দরবারপুরের এক দল দুষ্কৃতীর সঙ্গে এবং লাগোয়া গ্রাম মীরবাঁধের একটি গোষ্ঠীর বিরোধের জেরে শুক্রবার তুলকালাম বাধে বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি। ঘটনাচক্রে দরবারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার শেখের বাড়ি মীরবাঁধ গ্রামে। ওই ধুন্ধুমারের পরে ২৪ ঘণ্টা কাটলেও আনোয়ারের চোখে-মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ। বলেন, ‘‘শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ব্যাপক বোমাবাজি শুরু হতে স্কুলের পড়ুয়ারা কান্নাকাটি জোড়ে। মিল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেগতিক দেখে তা আধ-খাওয়া অবস্থায় পড়ুয়াদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’’

শুক্রবার গণ্ডগোলের জেরে স্কুল ছুটি দিয়েছিলেন আনোয়ার। শনিবারও স্কুল খোলেনি। আনোয়ার বলেন, ‘‘বাচ্চারা চলে যাওয়ার পরে বোমাবাজি বেড়ে যাওয়ায় মীরবাঁধে ফেরার সাহস পাচ্ছিলাম না। গ্রামের এক সহকর্মী আজিজুল হককে নিয়ে ঘণ্টাখানেক দরজা-জানলা বন্ধ করে স্কুলে বসেছিলাম। পুলিশ আসার পরে বোমাবাজি থামলে বাড়ি ফিরি!’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘সোমবার স্কুল খোলার কথা। দেখি, পরিস্থিতি কেমন থাকে!’’ লাগোয়া এলাকার দাঁড়কা উচ্চ বিদ্যালয়ও এ দিন বন্ধ ছিল। ওই স্কুলটিও সোমবার খুলতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।

আতঙ্ক এলাকার পড়ুয়াদের চোখেমুখেও। দরবারপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জুয়েল শেখ, তৃতীয় শ্রেণির আসমতি খাতুনরা বলে, ‘‘কাল ভয়ে স্কুলেও থাকতে পারছিলাম না, বাড়িও ফিরতে পারছিলাম না। পর-পর বোমা ফাটছিল। খুব ভয় করছিল!’’

আতঙ্কের অভিজ্ঞতা দরবারপুরের হানাই শেখেরও। প্রৌঢ়ের মেয়ের বিয়ে ছিল শুক্রবার। হানাই বলেন, ‘‘কোনও রকমে বিয়ের পাট মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে ফিরে যান বরযাত্রীরা। রান্না করা খাওয়ার মুখে তুলতে পারেননি কেউ!’’

দরবারপুরে এ দিন গিয়ে দেখা গেল, গোটা গ্রাম থমথমে। টহল দিচ্ছে পুলিশ বাহিনী। গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য। কয়েকটি পরিবারের দাবি, নিহতেরা ভাঙাচোরা লোহা কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। তাঁরা কেউ দুষ্কৃতী নন। বালি-মাফিয়াদের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে বেঘোরে মারা গিয়েছেন। আবার কয়েকজন নিহতের বাড়ির মহিলাদের মুখে কুলুপ। বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’-এক জন বৃদ্ধ বলেছেন, ‘‘বালির কারবার কারা করে সবাই জানে। তারা লড়াই করে। আমরা ভয়ে মরি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

DarbarPur Bomb Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE