ইকবালপুর রোডের বাসিন্দা বছর চোদ্দোর মহম্মদ আলির বাড়ির লোক গত আড়াই মাস ধরে ক্রমাগত খিদিরপুর মনসাতলা কলকাতা পুরসভার যক্ষ্মা ইউনিটের অফিসে এসে ঘুরে যাচ্ছেন। কিন্তু অত্যন্ত জরুরি ‘ক্লোফাজিমিন’ ট্যাবলেট আর ‘ক্যাপ্রিওমাইসিন’ ইঞ্জেকশন পাচ্ছেন না। ফলে যে ৭টি ওষুধ ওই কিশোরের পাওয়ার কথা, তার মধ্যে দু’টি সে আড়াই মাস খাচ্ছে না। অথচ তার ‘এক্সট্রিমলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি’ (এক্সডিআর) হয়েছে। এই যক্ষ্মায় পরিচিত বেশির ভাগ ওষুধ কাজ করে না। এই অবস্থায় কয়েকটি ওষুধে ছেদ পড়লে রোগীর যক্ষ্মা এমন পর্যায়ে যেতে পারে যে, তখন কোনও ওষুধই আর কাজ করবে না।
ধাপা এলাকার বাসিন্দা ৩২ বছরের এক আনাজ বিক্রেতাও গত দু’মাস ধরে ট্যাংরায় কলকাতা পুরসভার যক্ষ্মা ইউনিটে এসে ফিরে যাচ্ছেন। ‘ক্লোফাজিমিন’ ও ‘ক্যাপ্রিওমাইসিন’ পাননি। ওষুধে ছেদ পড়েছে তাঁরও। দু’দিন আগে তাঁকে কর্তারা শুধু ক্যাপ্রিওমাইসিন দিতে পেরেছেন।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এবং কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক বছরে কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রমাগত এক্সডিআর টিবি-র কেস পাওয়া যাচ্ছে।
এই মারাত্মক ধরনের যক্ষ্মার কেস বৃদ্ধির নমুনাটা কী রকম?
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের হিসেবে, কলকাতায় ৪৪ জন এক্সডিআর রোগী নথিভুক্ত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন ১৭ জন। ঠিক তার সাড়ে তিন মাস পরের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় এক্সডিআর রোগীর সংখ্যা ১৯ জন বেড়ে হয়েছে ৬৩ জন। এর মধ্যে ট্যাংরা, মানিকতলা, মনসাতলার মতো এলাকায় রোগীর সংখ্যা বেশি। যক্ষ্মা মোকাবিলায় নিযুক্ত সরকারি কর্তারাই স্বীকার করছেন, প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। কারণ, ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারে যাওয়া অধিকাংশ রোগীর নাম এখনও নথিভুক্তই করা যাইনি।
রোগী যখন এই হারে বাড়ছে তখন তার ওষুধও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ, ওষুধ সরবরাহতেই গোলমাল দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু এক্সডিআর ড্রাগ ও ইঞ্জেকশন মাসের পর মাস মিলছেই না। কলকাতা পুরসভার যক্ষ্মা বিভাগের প্রধান বিজয় করের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার এই ওষুধ সরবরাহ করে। সমস্যাটা তাদের তরফেই হচ্ছে। যেখানে বেশি ওষুধ দরকার সেখানে ওরা কম পাঠায়। আমরা নিজেরা যে টাকা দিয়ে কিনে নেব, সেটাও হয় না। কারণ এক্সডিআর যক্ষ্মার ওষুধ খোলা বাজারে মেলে না বললেই চলে।’’ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের যক্ষ্মা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার সুনীল খাপাডের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘রাজ্য এক্সডিআর যক্ষ্মার ওষুধের সরবরাহ নিয়ে আমাদের যে দায় চাপাচ্ছে, সেটি ঠিক নয়। আমরা ঠিক সময়েই ওষুধ পাঠাচ্ছি। ওদের বিতরণ পদ্ধতিতে সমস্যা রয়েছে। কলকাতার যে সব জায়গায় এই ওষুধ বেশি দরকার, সেখানে না পাঠিয়ে ওরা অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ও কলকাতা পুরসভা বারবার একই জিনিস করছে, আমরা ওদের উপরে বিরক্ত।’’
বোরাল যক্ষ্মা হাসপাতালে গত তিন মাসে এক্সডিআর যক্ষ্মার ১১টি কেস এসেছে। কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে প্রতি তিন মাসে এমন ৪-৫টি কেস মিলছে। কে এস রায় হাসপাতালের চিকিৎসক তরুণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানালেন, এই রোগীদের প্রয়োজনীয় দু’টি ওষুধ তিন মাস ধরে মিলছে না। এর বিকল্প ওষুধও সহজে বাজারে পাওয়া যায় না। চিকিৎসকদের চিন্তা একটা জায়গাতেই— এক্সডিআর রোগীরা ঠিকমতো ওষুধ না পেলে পুরোপুরি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হবেন। তাঁদের থেকে অন্যদের দেহে তখন ওই ধরনের যক্ষ্মাই ছড়াবে। সেই পরিস্থিতি কতটা সামলানো যাবে, এখন সেইটাই ভাবনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy