Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নুরকে ঘিরে পটের গান শুনতেন সাহেব, মেমরা

পূর্ব মেদিনীপুরের হবিচক থেকে লন্ডন অনেক দূর। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে পটের ছবি এঁকেই সেই পথ পেরিয়েছিলেন নুরদিন চিত্রকর। পূর্ব মেদিনীপুরের হবিচক থেকে লন্ডন অনেক দূর। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে পটের ছবি এঁকেই সেই পথ পেরিয়েছিলেন নুরদিন চিত্রকর।

স্ত্রী কল্পনার সঙ্গে নুরদিন চিত্রকর। নিজস্ব চিত্র

স্ত্রী কল্পনার সঙ্গে নুরদিন চিত্রকর। নিজস্ব চিত্র

তাঁর বিলেত যাত্রার কাহিনি বললেন আনন্দ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৮ ০৩:৪২
Share: Save:

ভারী জ্বালাতন করে ছেলে। মা-বাবা আঁকতে বসলেই হামলে পড়ত বছর আটেকের ছেলেটা। ছবিতে হাত দিত। আঁকতে চাইত। ছেলের হাত থেকে পট বাঁচাতে উপায় বের করলেন তাঁরা। ধরিয়ে দিতেন এক টুকরো আর্ট পেপার আর কঞ্চি। সেই কঞ্চি রঙে ডুবিয়ে ছেলে আঁকিবুকির ছবি আঁকায় মগ্ন হয়ে যেত।

নুরদিন চিত্রকরের আঁকার হাতে খড়ি এভাবেই। কঞ্চি থেকেই একসময়ে তুলি ধরেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের বাসিন্দা নুরদিন। পারিবারিক পটের ছবি আঁকার ঐতিহ্য বজায় রাখতে। তার পর এক সময়ে সেই ঐতিহ্যের জয়গাথা পৌঁছয় লন্ডন পর্যন্ত।

সহজ ছিল না বিলেত জয়ের যাত্রাপথ। কলকাতা থেকে দিঘাগামী সড়ক ধরে চণ্ডীপুর বাজার। সেখান থেকে নন্দীগ্রামগামী সড়কে পাঁচ কিলোমিটার দূরে হাঁসচরা বাজার। নুরের বাড়ি ওই বাজার থেকেও দু’কিলোমিটার ভিতর। হবিচক গ্রামে পৌঁছতে গেলে পার হতে হয় আঁকা- বাঁকা লাল মোরামের ছবির মতো পথ। হবিচকের লাল রাস্তা থেকে লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারে পৌঁছনোর পথটা বেশ কঠিন। লড়াইয়ে ভরা। গল্পকথার মতো। অবশ্য নুরদিনের পরিবারের ইতিহাস দীর্ঘ সফরের ইতিহাস। ঠাকুরদা তরণী চিত্রকর ঘাটালের নাড়াজোলের বাসিন্দা। এক সময়ে চলে এসেছিলেন মামার বাড়ি হবিচকে। পটচিত্রের গ্রামে। নুরদিনের বাবা গোলাপ চিত্রকর ও মা নুরজাহান চিত্রকর পটশিল্পী। পটচিত্র আঁকতেন, পটের গান বাঁধতেন। তার পর সেইসব ছবি-গান নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন গ্রামে গ্রামে। গান গেয়ে মিলত চাল-ডাল, কখনওসখনও নগদ পয়সা। একটু বড় হওয়ার পরে বাবার সঙ্গে চণ্ডীপুরের দামোদরপুর, ঈশ্বরপুর, ডিকাশিমপুরে পটের ছবি দেখিয়ে গান করতে বেরতেন নুরও।

এখন স্পষ্ট বলেন নুর, ‘‘আমরা ভিক্ষে করতাম।’’ এমন আক্ষেপ কেন? নুরের জবাব, ‘‘লোকে আমাদের ওরকমই ভাবত। মর্যাদা ছিল না আমাদের।’’ নুর জানান, হবিচকের পাশে নানকারচক, মুরাদপুর ও খড়িগেড়িয়া গ্রাম মিলিয়ে ১২৬টি পটুয়া পরিবারের বসবাস। সকলেই পটের ছবি দেখিয়ে, গান গেয়ে পাওয়া টাকা-চালের ভরসাতেই সংসার চালাতেন। পটশিল্পীরা কষ্ট পেয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছেন। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। তাঁদের দীর্ঘ চেষ্টাতেই পটচিত্র একসময়ে গুণগ্রাহীদের নজর পেয়েছে।

নজরে এসেছে নুরের কাজও। একটু বড় হতে বাবা-মা কঞ্চি ফেলে তুলি ধরিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের হাতে। শিখিয়েছিলেন রামায়ণ, মহাভারতের গল্প। তালিম দিয়েছিলেন বিভিন্ন পট তৈরির কৌশল। পুরাণ কথা থেকে সামাজিক বিষয় কী ভাবে পটের ছবির বিষয় হতে পারে তারও শিক্ষা পেয়েছিলেন নুর। কিন্তু চণ্ডীপুরের গণ্ডি পার হলেন কী ভাবে? ১৯৯৬ সালে কলকাতার কর বাগানে এক দুর্গামণ্ডপে পটের ছবি আঁকার দায়িত্ব নেন নুরদিন। কলকাতায় যাতায়াতের সেই শুরু। তারপর রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় যোগ দিতে শুরু করলেন। ২০১১-১২ সালে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোগ দফতর আয়োজিত পটচিত্র প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন। পরের বছরেই প্রথম পুরস্কার পান নুরদিন। ২০১৪ সালে রাজারহাটে রাজ্য সরকারের ‘বিশ্ববাংলা হাট’ ভবনের দেওয়াল জুড়ে পটচিত্র আঁকার দায়িত্ব পান নুরদিন। ৪০ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট উচ্চতার দেওয়াল জুড়ে দুর্গা এবং চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনীর পটচিত্র আঁকায় নুরদিনের সঙ্গে স্ত্রী কল্পনা, বাবা, মা-সহ গোটা পরিবার কাজ করেন।

২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লন্ডন সফরের কয়েকমাস পরেই লন্ডনে বাংলার হস্তশিল্পীদের কাজের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য সরকার। সেই প্রদর্শনীতে যাওয়ার সুযোগ পান নুর। তবে স্ত্রীকে হারিয়ে। নুরের স্ত্রী কল্পনাই ওই প্রদর্শনীর জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। পিংলার নয়া গ্রামের মেয়ে কল্পনাও নামী পটচিত্রী। কিন্তু সেই সময়ে কল্পনার পাসপোর্ট ছিল না। তাই তাঁর যাওয়া হয়নি। ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পাঁচদিন লন্ডন ডিজাইন ফেস্টিভ্যালে ছিলেন নুর। কেমন ছিল সেখানকার অভিজ্ঞতা? হবিচকের গ্রামের বাড়িতে বসে নুরের স্মৃতিচারণ, ‘‘কোনওদিন ভাবিনি লন্ডনে পট নিয়ে যাব। স্বপ্নের মত ছিল ব্যাপারটা।’’

নুর ব্যাগে করে নিজের আঁকা ২৫টি নানা বিষয়ের পটচিত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলির মধ্যে ২১টি পট বিশ্ববাংলা কর্তৃপক্ষ নিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। তার জন্য অর্থও পেয়েছেন তিনি। পটের ছবিতে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক রং। বোতলে করে কাঁচা আঠা, বেলের রস, ভুষা কালি, কাঁচা হলুদ, সিম পাতা, জাফরান ফল, পান, খয়ের, চুন নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেস্টিভ্যালে বিশ্ববাংলার স্টলে বসেই নানারকমের পট আঁকতেন। সাহেব-মেমরা ভিড় করতেন তাঁর স্টলে। তাঁদের ছবি দেখাতে দেখাতে নুর গাইতেন রামায়ণ কথা, ‘‘বিয়ে হল রামচন্দ্রের, হলেন অধিবাস/পিতার সত্য পালিতে রাম, যায় বনবাস/আগে চলে রামচন্দ্র, পশ্চাতে জানকী/তাঁহারও পশ্চাতে চলে লক্ষ্মণ ধানুকি’। গান শুনে উচ্ছ্বসিত শ্রোতারা হাততালি দিতেন। ভাষাগত সমস্যা ছিল। কিন্তু গানের সুর আর ছবির বিষয় মিলেমিশে এক হয়ে যেত। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি-সহ বিভিন্ন শিল্প সমঝদারেরা ছিলেন তাঁর গান এবং ছবির ভক্ত। রামায়ণ গানে এবং ছবিতে বিদেশিদের আগ্রহ দেখেছিলেন নুর। একদিন পটের ছবি আঁকা দেখে এক ফরাসি পর্যটক তাঁর হাতে ট্যাটু করে দেওয়ার আবদার জানান। নুর তাঁর হাতে কালো রং দিয়ে এক আদিবাসী যুবকের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। তাতেই আপ্লুত ওই মহিলা।

ভাষা নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল লন্ডনে। তৃতীয় শ্রেণির পরে আর পড়াশোনা হয়নি। ফলে ইংরাজিতে বাধা লাগত। প্রথম দু’একদিন খুব আড়ষ্ট ছিলেন। পরে ঠিক হয়ে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া ইংরাজিতেই কথা বলতেন স্টলে আসা বিদেশিদের সঙ্গে। বিলেত ফেরত নুরের অভিজ্ঞতা, পটের চাহিদা রয়েছে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই। এমনকী আরব দেশেও পট বিক্রির বাজার রয়েছে। তবে তাঁর মতে, পটচিত্র দিয়ে ঘরবাড়ি, হোটেল সাজানোর পাশাপাশি নানা ব্যবহারিক জিনিসে পটের ব্যবহার করতে পারলে এই শিল্পের উন্নতি হবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টেবিল-চেয়ার-সহ নানা আসবাবপত্রে পটচিত্র ব্যবহারের আগ্রহ দেখেছেন তিনি। নুর এবং স্ত্রী কল্পনাও সব শ্রেণির মানুষের ব্যবহার করার মতো পটচিত্র তৈরি করেন। সে জন্য তাঁদের পটের দাম ২০ টাকা থেকে এক লক্ষ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কল্পনাদেবী লন্ডন যেতে পারেননি বলে মন খারাপ করেননি? নরু বলেন, ‘‘রোজ ফোন করতাম। সারা দিন যা ঘটেছে তার বিবরণ দিতাম।’’

পটের ঐতিহ্য ধরে রাখার বিষয়ে নুর এবং কল্পনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বছর একচল্লিশের নুরের তিন ছেলে। তিন জনেই পটচিত্র আঁকা শিখছে। নুর ছেলেদের জানিয়েছেন, তারা যা খুশি পেশা বেছে নিতে পারে। কিন্তু পারিবারিক পটচিত্র আঁকা যেন তারা না ছাড়ে। কারণ চিত্রকর তাঁদের আত্মপরিচয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Patua Paintings East Midnapore heritage art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE