Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘কী হবে আমাদের’, প্রশ্ন মন্ত্রী-আমলাকে

নোট-আকালের বাজারে আত্মঘাতী ভাগচাষির স্ত্রীকে বিধবা ভাতার টাকা দিতে যাওয়া রাজ্যের মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, ‘‘আমাদের কী হবে?’’ একই জিজ্ঞাসা রাজ্যের কৃষি পরিস্থিতি দেখতে আসা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যাকেও।

ভাতারে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিকে ঘিরে চাষিদের বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র।

ভাতারে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিকে ঘিরে চাষিদের বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৭
Share: Save:

নোট-আকালের বাজারে আত্মঘাতী ভাগচাষির স্ত্রীকে বিধবা ভাতার টাকা দিতে যাওয়া রাজ্যের মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, ‘‘আমাদের কী হবে?’’ একই জিজ্ঞাসা রাজ্যের কৃষি পরিস্থিতি দেখতে আসা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যাকেও। বুধবার বর্ধমানের কালনা আর ভাতারের এই দু’টুকরো ছবিতে প্রশ্নকর্তাদের পেশাটা এক— চাষ। বাজারে নগদের অভাবে ধান কাটতে না পেরে, কাটা ধান বেচতে না পেরে, আলু বীজ, পেঁয়াজ চারা কিনতে না পেরে— এর পরে কী হবে সেই চিন্তায় যাঁদের কপালে ভাঁজগুলো ক্রমে গাঢ় হচ্ছে। বাড়ছে প্রশ্নের সংখ্যা। সংশয়।

কালনার রাহাতপুরে আত্মঘাতী চাষি শিবপদ মান্ডির পরিবারকে টাকা দিতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। মৃত চাষির বাড়িতে মন্ত্রী, পঞ্চায়েতের কর্তাদের দেখে জমে ওঠে পড়শি চাষিদের ভিড়। জনতা জানায়, শিবপদর মতো একই কৃষি সমবায়ের বহু গ্রাহক সেখানে হাজির, যে সমবায়ে বার-বার গিয়েও টাকা না থাকায় ফিরে আসতে হয়েছে অনেককে। ঘরে টাকা না থাকায় মজুর লাগিয়ে ধান কাটা যাচ্ছে না। পাকা ধান ঝরে পড়ছে মাঠে। নগদ নেই বলে হাত তুলে নিয়েছেন মহাজনেরা। ফলে, অন্য বছর যেখানে এ সময় মাঠ থেকে আমন ধান উঠে যায়, শুরু হয়ে যায় আলু, পেঁয়াজ চাষের প্রস্তুতি— এ বার সে পাটই নেই।

গোবিন্দ ঘোষ, খোকন মল্লিক, শিবু মালিকের মতো বহু চাষি মন্ত্রীকে বলেন, ‘‘স্যার, শিবপদর পরিবার ভাতা পাবে ভাল কথা। আমাদের কী হবে বলুন?’’ দৃশ্যতই বিব্রত স্বপনবাবু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদারের শরণাপন্ন হন। ফোনেই প্রদীপবাবু আশ্বাস দেন, একটি কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল চাষিদের অবস্থা দেখতে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি।

ঘটনাচক্রে এ দিনই দুপুরে ভাতারের স্বর্ণচাঁদা গ্রামে সমবায় পরিদর্শনে গিয়ে চাষিদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন কেন্দ্রীয় দলের সদস্যা, সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের ডিরেক্টর দেবযানী চক্রবর্তী। বিক্ষোভে সামিল শ’খানেক চাষির বক্তব্য, হাতে নগদ নেই, তাই খেতের ফসল তুলতে মজুর লাগাতে পারছেন না তাঁরা। যেটুকু ধান কাটা গিয়েছে তা কেনার লোক নেই। বিভিন্ন কৃষি সমবায় ফি বছর এই সময়ে চাষিদের কাছ থেকে ধানের বীজ কেনে। এ বার সমবায়ের হাতে টাকা না থাকায় পুরো প্রক্রিয়াটাই থমকে গিয়েছে। কিসান ক্রেডিট কার্ড থাকলেও মিলছে না কৃষিঋণ। চাষিদের দাবি, কেন্দ্র সরকার চাষি পিছু ২৫ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বললেও এক-একটা সমবায় সপ্তাহে যত টাকা পাচ্ছে, তাতে নগদে পাঁচশোটাকার বেশি কোনও চাষিকে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফের ওঠে প্রশ্ন, ‘‘আমাদের চলবে কী ভাবে?’’

দেবযানীদেবী চাষিদের কাছেই জানতে চান, কী করলে সমস্যা মিটবে? জবাব আসে, ‘‘নগদ টাকার ব্যবস্থা করুন।’’ দেবযানীদেবী সাত দিনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশ্বাস দেন। বলেন, ‘‘এলাকা দেখলাম। রিপোর্ট পাঠাব।’’ রবি মরসুমের আগে চাষিদের হাতে নগদ না এলে উৎপাদন কমে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। দেবযানীদেবীর মতোই কৃষি মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব রাঘবেন্দ্র সিংহ, কয়লা মন্ত্রকের যুগ্মসচিব বিবেক ভরদ্বাজেরা ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে ও বাজারে ঘুরে কথা বলেছেন। নবান্নে রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে এ দিন ছিলেন কেন্দ্রের এই তিন আমলাই। বৈঠকে রাজ্যের ন’টি দফতরের সচিব, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা রেখা ওয়ারিয়ার ছাড়াও স্টেট ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

নবান্ন সূত্রে খবর, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতি যে ভেঙে পড়েছে, তা এ দিন কেন্দ্রের আমলা এবং ব্যাঙ্কের কর্তাদের স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়। টাকার অভাবে আলু চাষে যে রাজ্যের চাষিরা সমস্যায় পড়েছে তা এ দিনের বৈঠকে কিছুটা মেনেছেন কেন্দ্রীয় সচিব রাঘবেন্দ্র। কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্টে সে তথ্য থাকবে বলে রাজ্যের আধিকারিকদের জানিয়েছেন। পরে নবান্নে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, ‘‘টাকার অভাবে ৫০ শতাংশ জমিতে ধান পড়ে আছে। চাষিরা আলু বুনতে পারেননি। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে পশ্চিমবঙ্গ!’’

নোট-বাতিলের সিদ্ধান্তে জনমত সমীক্ষার জন্য মোবাইল অ্যাপের সাহায্য নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২৪ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ সেই সমীক্ষায় সাড়া দিয়েছেন। এবং ৯৩ শতাংশই সেই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বলে দাবি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের। রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী একাধিক দলের ওই নেতাদের টিপ্পনি, ‘‘মোদী উত্তর চাইছেন। বদলে আসছে প্রশ্ন। চাষিদের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কী ভাবে বাঁচব’?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE