উঠোন থেকেই নজর সভায়। মঙ্গলবার পাত্রসায়রের হাটতলা ময়দানে। —নিজস্ব চিত্র।
উঠোন-বার করছিলেন তিনি। উঠোনে থাকা আত্মীয়দের বলছিলেন— ‘‘এখানে দাঁড়ান। গাড়ি থেকে নামলেই ওনাকে দেখতে পাবেন। দুয়ারে যাঁদের জায়গা হচ্ছিল না, তাঁদের নিয়ে যাচ্ছেন ব্যারিকেডের সামনে। তখনও সে ভাবে ভিড় হয়নি। সেখানেই তাঁদের বসিয়ে দিচ্ছিলেন। কাউকে বলছিলেন, কাগজ, জামা ফেলে জায়গা দখল করে রাখতে। বাড়ির সামনের মাঠে সভা করতে আসা মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার সুযোগ করে দিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে এ ভাবেই দৌড়ে বেড়ালেন পাত্রসায়রের হালতলা ময়দানের বাসিন্দা ইদচাঁদ আলি খান।
ইদচাঁদের বাড়িতে পুরুষ-মহিলা, ছেলে-বুড়ো আত্মীয়দের ভিড়ে জমজমাট। হেঁশেল সামলাতে সামলাতে তাঁর স্ত্রী সেলিনা বিবি আত্মীয়দের বলে যাচ্ছিলেন, রান্নাটা সকাল সকালই সেরে নিয়েছেন। কেউ যেন খালি পেটে সভার ভিড়ে না ঢুকে যান। তাহলে সভা শেষ হতে হতে পেটে ডন টানবে। আত্মীয়দের সেবা করতে কার্যত একই অবস্থা ওই এলাকার অনেকেরই। সবারই বাড়ি ভর্তি আত্মীয়। দিনভর চলছে সমানে হইচই। সব মিলিয়ে একটা উৎসবের মেজাজ দেখল পাত্রসায়র।
বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, মমতার প্রতি জনতার আকর্ষণ আজকের নয়। দীর্ঘদিনের। মুখ্যমন্ত্রী সেটা বিলক্ষণ জানেন। তাই তাঁকে ঘিরে গ্রামাঞ্চলে যে উন্মাদনা তৈরি হবে, তা বলাই বাহুল্য। আর মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি পাত্রসায়রে এই প্রথম এলেন। তাই তাঁকে ঘিরে এলাকায় এমনই উৎসবের চেহারা নিয়েছে।
এ দিন এলাকার খোঁজ করে জানা গেল, প্রায় প্রতিটি ঘরেই দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়েরা এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে এক বার সামনে থেকে দেখতে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, টানা ক’দিন ধরেই এলাকায় ঘন ঘন ভিআইপি গাড়ির আনাগোনা চলছিল। রাজ্যের মন্ত্রী থেকে জেলাশাসক, সভাধিপতি থেকে পুলিশ সুপার-সহ জেলা তৃণমূলের তাবড় নেতারা দফায় দফায় মাঠ পরিদর্শন করতে এসেছেন। সেই সঙ্গে সোমবার রাত থেকেই পুলিশ কর্মীদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো।
স্থানীয় বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী সাত্তার আলি খান বলছিলেন, “গত ক’দিন ধরেই এলাকা জমজমাট হয়ে ছিল। মাঠে দিনভর কাজ চলেছে মঞ্চ বাঁধার, হেলিপ্যাড গড়ার। বাড়ির সামনের মাঠে মুখ্যমন্ত্রী সভা করতে আসছেন শুনেই আত্মীয়েরাও এসে উপস্থিত হয়েছেন।’’ সাত্তার সাহেবের স্ত্রী হীরাবিবি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সভা দেখতে আসা আত্মীয়দের নিয়ে বেশ হইচই করেই কাটল এই ক’টা দিন। প্রতিদিনই ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া চলছিল। সব মিলিয়ে একটা উৎসবের মেজাজ।’’
সভাস্থলের মাঠের গায়েই বাড়ি স্কুল শিক্ষক ইদচাঁদ আলি খানের। ইদচাঁদের বেয়ান আনোয়ার বেগম এসে উপস্থিত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখার আশা নিয়ে। এ দিন বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়েই সভাস্থলের দিকে চোখ রাখছিলেন আনোয়ার বেগম, ইদচাঁদ সাহেবের স্ত্রী সেলিনা বিবি ও বৌমা ডালিয়া বেগম। আনোয়ার বেগম বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আসবেন বলে সকাল সকাল খাওয়া-দাওয়া, কাজ-কম্মের পাট চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়ের ঘর দুয়ারে যখন এত বড় মাপের এক নেত্রী আসছেন, তখন তাঁকে দেখতে আসব না, সেটা কি হয়?”
ইদচাঁদ জানান, গত ক’দিন ধরেই বাড়িতে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গিয়েছে। মঞ্চ বাঁধার কাজে আসা শ্রমিকদেরও নানা সুবিধা অসুবিধার খোঁজ রেখে যাচ্ছিলেন তাঁরা। সভার দিন সকাল থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য তাঁদের বাড়ির ছাদে ঘাঁটি গেড়েছিলেন কয়েক জন পুলিশ কর্মী। দেখভাল করতে হয়েছে তাঁদেরও।
এরই মাঝে মুখ্যমন্ত্রীর চপার পুরুলিয়া থেকে হাটতলা ময়দানের আকাশে সশব্দে এসে পড়তেই হই হই কাণ্ড বাধে। সকলেই সিড়ি বেয়ে দৌড় লাগান ছাদের দিকে। যদিও পুলিশ কর্মীদের কড়াকড়ির জন্য চপার নামার সময়ে ছাদে থাকতে পারেননি কেউই! এরপর মুখ্যমন্ত্রীকে এক ঝলক দেখতে বাড়ির সামনে মাঠের ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ডালিয়া বেগম, আনোয়ার বেগম, সেলিনা বিবিরা। তবে কোথাও ভিড়ের ঠেলায়, আবার কোথাও পুলিশ কর্মীদের নিষেধের জেরে মুখ্যমন্ত্রীকে চোখ ভরে দেখার সুযোগটাই পেলেন না। তাঁদের বাড়ির সামনেই একটি জায়ান্ট স্ক্রিন লাগিয়েছিল প্রশাসন। পুলিশ কর্মীরা ওই স্ক্রিনেই মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে বলেন। ডালিয়া বিবি বলেন, “টিভিতে তো রোজই মুখ্যমন্ত্রীকে দেখি। আমরা ভেবেছিলাম সামনে থেকে তাঁকে দেখবার সুযোগ পাব। মাঠের এক কোণে সভামঞ্চ গড়া হয়েছে। ব্যারিকেড পার হয়ে পুলিশ ঢুকতেও দিচ্ছে না। তাই মন ভরে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার আশা মিটল না।”
তবে আশাহত হননি অনেকে। হাটতলা ময়দান এলাকাতেই বাড়ি আব্দুল আলি খানের। তাঁর বাড়িতেও এসেছেন মেয়ে-জামাই। এমনকী দেশের বাড়ি পদুয়া থেকেও এসেছেন অনেকেই। ভিড়ের মধ্যে জায়গা পেতে তাঁরাও হুটোপুটি করছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে তাঁদের অনেকে হাত নেড়ে স্বাগত জানিয়েছেন। শেখ মনির হোসেনেরও বাড়িতেও বহু আত্মীয়েরা এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আত্মীয়েরা মুখ্যমন্ত্রীকে কাছে দেখার এই সুযোগ ছাড়তে চাননি। আমিও সাদরে ডেকে নিয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy