Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পুণ্যের সঙ্গে পেটেরও দাবি পূরণ গঙ্গাসাগরে

সাগর কিছুই নেয় না। সবই ফিরিয়ে দেয়। আর গঙ্গাসাগর ফিরিয়ে তো দেয়ই। সেই সঙ্গে ভক্তজনকে পুণ্য দেয় তো পেটের টানে মেলায় আসা মানুষকে দেয় রুটিরুজির হদিস।

পুণ্য-ডুব। শুক্রবার গঙ্গাসাগরে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

পুণ্য-ডুব। শুক্রবার গঙ্গাসাগরে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

মধুরিমা দত্ত
গঙ্গাসাগর শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৫
Share: Save:

সাগর কিছুই নেয় না। সবই ফিরিয়ে দেয়। আর গঙ্গাসাগর ফিরিয়ে তো দেয়ই। সেই সঙ্গে ভক্তজনকে পুণ্য দেয় তো পেটের টানে মেলায় আসা মানুষকে দেয় রুটিরুজির হদিস।

ফিরিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পেলেন ঝাড়খণ্ড থেকে আসা প্রৌঢ়া শান্তিদেবীর সঙ্গীরা। গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার পথে দলছুট হয়ে গিয়েছিলেন শান্তিদেবী। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাস্তাতেই অসুস্থ অবস্থায় বসে থাকতে দেখে তাঁকে হাসপাতলে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তাঁর দলের লোকেদের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।

আর গঙ্গাসাগরের দেওয়ার বহর তো অপরিমেয়। পুণ্যকামীর হৃদয় যদি সেই দানের আধার হয়তো, পেটের চাহিদা মেটাতে আসা মানুষের ঝুলিও সাগরের দানেই কমবেশি পূর্ণ। পুণ্যার্থী যত, তত পসারি। জেলাশাসক পি বি সালিম শুক্রবার জানান, দুপুর পর্যন্ত পুণ্যার্থীর সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ। গঙ্গাসাগরে মকরস্নানের ছবিটাকে আবহমান ইতিহাস বললে ভুল হয় না। উত্তর ভারতের অলিগলি থেকে, দক্ষিণের ঐতিহ্যবাহী মন্দিরের কোণ থেকে ভক্তেরা এসেছেন সাগরসঙ্গমে। রাজস্থানের বালিয়াড়ি পেরিয়ে, পূর্ব ভারতের পাহাড়ি গ্রাম থেকে লাখে লাখে মানুষ গভীর বিশ্বাস নিয়ে জড়ো হয়েছেন মকরসংক্রান্তির সাগরসঙ্গমে। কেউ সূর্যপ্রণাম করে এবং ঠান্ডা জলে ডুব দিয়ে পুণ্যকামনা চরিতার্থ করছেন। ওই সব কৃত্য ছাড়াও কেউ কেউ সাগরের ভেজা বালিতে শিবলিঙ্গ গড়ে প্রার্থনা করেছেন নিজের মতো।

এক দিকে ভক্তহৃদয়ের আকুলতা তো উল্টো পিঠে রুজিরোজগারের ফিকির। সাগরে ডুব দিতে দিতেই নৈহাটির বছর আটেকের ঋক পাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, ‘‘ওই দেখো, অসুর।’’ অসুরের পায়ের সামনে গামছায় ১০ টাকার নোট জমা হয়েছে বেশ কিছু। জমে উঠেছে চাল, ডাল, বেলপাতা, কলাও।

অসুরের সঙ্গে নিজস্বী তুলতেও ব্যস্ত অনেকে। কাছে যেতেই জানা গেল, এই অসুর আসলে হরিণবাড়ির মনসাচরণ গায়েন। প্রতি বছরই এ ভাবে সেজে মেলায় দাঁড়ান, আয় হয় কিছু। মাথায় নকল ঝাঁকড়া চুল, কানে বড় দুল, নিম্নাঙ্গে রঙিন খাটো ধুতি। পেশায় ভ্যানচালক মনসাচরণ জানান, শুধু এই মেলা নয়, দুর্গাপুজোয়, গ্রামের অন্যান্য অনুষ্ঠানেও বহুরূপী সাজেন তিনি। ‘‘ছোটবেলায় গান গাইতাম, পেটের টানে রিকশা চালাই। তবু যখনই সুযোগ পাই, সাজি। ঢোল বাজিয়ে গান গাই। মনটা খুশি-খুশি লাগে। আমায় দেখে লোকেরাও খুশি হয়,’’ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা ছাপিয়ে মনসাচরণের চোখেমুখে পরিতৃপ্তি।

সাগরের জলে চুম্বক নিয়ে তখন মাতামাতি করছে বছর আটেকের মোমিন দাস। পাশেই দাঁড়ানো বাচ্চুর দিল অবশ্য ততটা খুশ নয়। সকাল সকাল জলে চুম্বক ফেলে তত ক্ষণে ৮০ টাকা রোজগার করেছে মোমিন। বাচ্চুর ভাঁড়ারে ৪৪। পয়সার বদলে বেশির ভাগ সময়েই যে তার হাতে উঠে এসেছে পুজোর ফুল-বেলপাতা! বাচ্চু জানায়, পুণ্যার্থীদের দেওয়া প্রণামী কুড়িয়েই বেশ আয় হয়। সে বলে, ‘‘মেলার ক’দিন স্কুল ছুটি থাকে। পয়সা কুড়িয়ে মাকে দিই। মা জামা কিনে দেয়।’’

কেউ পুণ্য চায়, কেউ বা পয়সা। লক্ষ মানুষের এমন লক্ষাধিক প্রার্থনা নিয়েই গঙ্গাসাগরে ফি-বছর লেখা হয় নতুন ইতিহাস। লেখা হয় মানুষের বিশ্বাসের পদাবলি। প্রস্তুতি শুরু হয় অপেক্ষা আগামী মেলার।

এ বার গঙ্গাসাগর মেলার থিম ছিল ‘ক্লিন গঙ্গাসাগর’। আবর্জনা দেখলেই স্বেচ্ছাসেবকেরা পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তবে শেষরক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত পুণ্যার্থীর ভিড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে পরিকাঠামো। প্রতি বছর গঙ্গাসাগরে ছবি তুলতে যান বেহালার সঞ্জয় বিশ্বাস। বললেন, ‘‘অন্যান্য বারের চেয়ে এ বার মেলা অনেক পরিষ্কার। তবে ক্লিন গঙ্গাসাগরকে একশোয় বড়জোর ষাট দেওয়া যেতে পারে। তার বেশি নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gangasagar madhurima dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE