Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
শাবল, লাঠি হাতে এ কেমন স্মারকলিপি, প্রশ্ন উপাচার্যের

পতাকা দেখেই কি ভোলবদল

রাত পোহাতেই পাল্টে গেল চেহারা। সোমবার যে পুলিশকে রক্ষক মনে হয়েছিল পড়ুয়াদের একাংশের, মঙ্গলবার সেই পুলিশেরই অন্য রূপ দেখে তাঁরা অবাক। ছাত্রছাত্রী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের একটি অংশের দাবি, এসএফআইয়ের পতাকা হাতে আন্দোলন শুরু হতেই অন্য ভূমিকা নিল পুলিশ।

 ক্যাম্পাসের গেটের বাইরেও পুলিশের মার।

ক্যাম্পাসের গেটের বাইরেও পুলিশের মার।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৩৬
Share: Save:

রাত পোহাতেই পাল্টে গেল চেহারা। সোমবার যে পুলিশকে রক্ষক মনে হয়েছিল পড়ুয়াদের একাংশের, মঙ্গলবার সেই পুলিশেরই অন্য রূপ দেখে তাঁরা অবাক। ছাত্রছাত্রী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের একটি অংশের দাবি, এসএফআইয়ের পতাকা হাতে আন্দোলন শুরু হতেই অন্য ভূমিকা নিল পুলিশ।

পরীক্ষার ফলে ভুলের অভিযোগে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়েছে সোমবার থেকে। সে দিন পুলিশ না থাকলে তৃণমূল প্রভাবিত একটি কর্মচারী সংগঠনের লোকজনের হাতে তাঁদের আক্রান্ত হতে হত বলে দাবি করেছিলেন এসএফআই সমর্থক এক দল পড়ুয়া। এমনকী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তাকে বিক্ষোভকারীদের হাতে হেনস্থা হতে দেখেও তখন চুপ ছিল পুলিশ। আর সেই পুলিশই এ দিন এসএফআইয়ের আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে লাঠি চালায় বলে অভিযোগ। এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেন রায় বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় সময়ে ফল বের করতে পারে না, তা জানতে গেলে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়। সবটাই হয় পতাকার রং দেখে।’’

মঙ্গলবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ভিন্ন সুর শোনা গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যেও। উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার বলেন, ‘‘মোটা বাঁশ, লাঠি, শাবল নিয়ে স্মারকলিপি দিতে এসেছিল ছাত্রছাত্রীরা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে উত্তরপত্র বিভাগে ঢুকে পড়েছিল। আমাদের সোমবারের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। সেই দেখেই পুলিশ ডেকেছিলাম। তার পরে যা হয়েছে তা পুলিশের বিষয়।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘রাজবাটীর প্রশাসনিক ভবন ঐতিহ্যশালী ভবন। অনেক টাকা খরচ করে তা সাজিয়ে তুলেছি আমরা। রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। সম্পত্তি রক্ষার জন্য পুলিশ ডাকা হয়েছিল।’’

গেট টপকে ঢুকছে ছাত্রেরা।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, শাবল দিয়ে গেটের তালা ভেঙেছে পড়ুয়ারা। তার পরে ভেতরে ঢুকে লন্ডভন্ড করেছে। উপাচার্যের আরও বক্তব্য, ‘‘যারা লাঠি হাতে, শাবল নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে আসে তারা কেমন ছাত্র, জানতে ইচ্ছা করছে।’’ যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দেবকুমার পাঁজা পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘‘সম্পত্তি রক্ষার জন্য পুলিশ ডাকা হয়েছিল, ছাত্রছাত্রীদের মারার জন্য নয়। এই ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। পুলিশ কেন লাঠি চালাল, আমরা জানতে চাইব। পড়ুয়াদের উপর লাঠি চালাবে কি না, তা জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করেনি পুলিশ!’’

ফলপ্রকাশে দেরি, ফলে ভুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে এসএফআইয়ের এ দিনের মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল পূর্বঘোষিত। কিন্তু শ’চারেক পড়ুয়া বর্ধমান স্টেশন থেকে মিছিল করে রাজবাটী ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখেন, মূল গেট বন্ধ। ভিতরে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ। কয়েক জন পাঁচিল ও গেট টপকে ঢুকে পড়েন। অভিযোগ, বাকিরা গেটের তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন। উপাচার্যের ভবনের সামনে পৌঁছে বিক্ষোভকারীরা দেখেন, গেট বন্ধ। কোনও কর্মীরও দেখা নেই। তখন রেজিস্ট্রারের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন পড়ুয়ারা।

এরই মধ্যে কিছু ছাত্র দফতরের কোলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। আর তাতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কয়েক জন মহিলা পুলিশকর্মীও চলে আসেন। এসডিপিও (বর্ধমান সদর) সৌমিক সেনগুপ্তের সঙ্গে বচসা বাধে পড়ুয়াদের। অভিযোগ, তিনি ছাত্রদের ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের উপরে লাঠি চালানো। পড়ুয়ারা যে যে দিকে পারেন, পালাতে থাকেন। রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। ভবন থেকে তাড়া করে আন্দোলনকারীদের রাস্তায় পাঠিয়ে দেয় পুলিশ।

এসএফআইয়ের দাবি, পুলিশের লাঠিতে ২৫ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সংগঠনের জেলা সম্পাদক দীপঙ্কর দে, রাজ্য কমিটির সদস্য সৌমেন কিস্কু, চন্দন সোম, বিনোদ দাস-সহ ১১ জন একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। এসএফআই সূত্রে জানা যায়, ২০১১-এর পর থেকে ১৭-১৮ বার নানা দাবিদাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে তারা। কিন্তু কোনও বারই দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাই এ বার মরিয়া হয়ে গেটের তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে ছাত্রছাত্রীরা। এসএফআইয়ের রাজ্য কমিটির সদস্য বিনোদ ঘোষের অভিযোগ, ‘‘আমাদের উপরে আক্রমণ করতে ক্যাম্পাস জুড়ে টিএমসিপি এবং তৃণমূলের শিক্ষাকর্মীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু পুলিশ যে এ ভাবে গুন্ডামি করবে, ভাবতে পারিনি। আরও আশ্চর্যের, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও কর্তা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এলেন না!’’

ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন ছিল সোমবার দুপুর থেকেই। রেজিস্ট্রার সে দিনও জানিয়েছিলেন, সম্পত্তি রক্ষার জন্য পুলিশ ডেকে পাঠানো হয়েছে। ছাত্র-আন্দোলন জোর করে বন্ধ করার কোনও উদ্দেশ্য তাঁদের নেই। এ দিনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ডাকেই ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল বলে জানান পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল। তবে লাঠি চালানোর কথা অস্বীকার করেন তিনি। তবে এসডিপিও সৌমিকবাবু বলেন, ‘‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যা ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল নিয়েছি।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের কয়েক জন কর্মীর টিপ্পনী, ‘‘মঙ্গলবার কোনও পতাকা ছাড়া রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পরীক্ষা নিয়ামককে ঘেরাও, হেনস্থা করে কিছু পড়ুয়া। তখন পুলিশ নিশ্চুপ ছিল। আজ এসএফআইকে দেখেই অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে।’’ এ দিন সন্ধ্যায় বর্ধমান শহরের সিপিএম নেতাদের একটি দল পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে গোটা ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ জানান।

এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘যাদবপুরে তীব্র আন্দোলনেও এ বার ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকেননি উপাচার্য। অথচ, পড়ুয়াদের দাবিদাওয়া জানানোর মতো কর্মসূচি বানচাল করতে এখানে পুলিশ ডেকে বসলেন উপাচার্য। এটা বর্ররোচিত কাজ হল।’’ পড়ুয়াদের উপরে লাঠি চালানোর নিন্দা করেছে শিক্ষক-মহল। কাটোয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ দেবপ্রসাদ সামন্তের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ছাত্রদের আচরণ ছাত্রসুলভ ছিল না। কিন্তু কর্তৃপক্ষকে আরও উদার হতে হতো। পুলিশেরও ধৈর্য্য ধরা উচিত ছিল।’’ কাটোয়া কলেজের শিক্ষক অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘পুলিশ নয়, সমস্যার সমাধান হতে পারত আলোচনার মাধ্যমেই।’’

টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রের পাল্টা অভিযোগ, ‘‘ক্যাম্পাসে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে এসএফআই। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি, আমাদের পতাকা ছিঁড়ে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার আমাদের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করবে।’’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, আজ, বুধবার পরীক্ষার সূচি নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে সমস্ত কিছু নিয়েই আলোচনা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE