তৃণমূলের পতাকায় ছেয়ে গিয়েছে বামনগাছি। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র
চব্বিশ ঘণ্টাও কাটল না, সুর বদলে গেল!
দুষ্কৃতীদের হাতে কলেজ ছাত্র সৌরভ চৌধুরী খুনের সাত দিন পরে শুক্রবার বামনগাছি গিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় জানিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতি করতে আসেননি। কিন্তু শনিবার উত্তর ২৪ পরগনারই বসিরহাটের সরবেরিয়ায় এক দলীয় সভায় সেই মুকুল রায়ই বললেন, “সৌরভ তৃণমূল ছাত্র পরিদের কর্মী ছিল। সে ছবি আমাদের কাছে আছে। এখন ওর বাবা বলছেন, সৌরভ কোনও রাজনীতি করত না।” একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর সংযোজন, “আমরা মনে করি, এ নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। কিছু মিডিয়া বাংলার সম্মানকে ছোট করতে নেমেছে।”
মুকুলবাবুর বক্তব্য জানার পরে সৌরভের বাবা সরোজ চৌধুরী বলেছেন, “কে কী বলছেন, জানি না। সবাইকে বলেছি, আমার ছেলে কোনও রাজনীতি করত না। ওর মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি হোক, তা-ও চাই না।”
রাজনীতি চাইছেন না নিহতের পরিবার। চাইছেন না গোটা বামনগাছির মানুষ। কিন্তু সৌরভকে রাজনীতির ছেলে বলে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা চলছেই! যেমন ঘটনার পরপরই বিজেপি জানিয়েছিল, সৌরভ তাদের দলের সক্রিয় কর্মী। যে হেতু সরোজবাবু এলাকায় বিজেপি কর্মী হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর স্ত্রী মিতাদেবী গত পঞ্চায়েত ভোটে ওই দলের প্রার্থী ছিলেন, তাই সৌরভ-খুনের পরপরই বিজেপি নেতারা তাকে নিজেদের সক্রিয় কর্মী বলে দাবি করেন। যদিও বিজেপি-র ওই দাবিকে প্রশ্রয় দেয়নি সৌরভের পরিবার। এর পরেই মাঠে নামে শাসক দল তৃণমূল। শুক্রবার বামনগাছির সভায় দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে সৌরভের ছবি দেখিয়ে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা নিহতকে তাঁদের দলের সদস্য বলে দাবি করেন। এতেও আপত্তি জানায় সৌরভের পরিবার। পরে মুকুলবাবুর সঙ্গে কথা বলার সময় সৌরভের বাবা বিষয়টি তুললে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক জানিয়ে দেন, তিনি রাজনীতি করতে আসেননি। দোষীরা যাতে দ্রুত শাস্তি পায়, সেটাই তিনি দেখবেন। শুক্রবার এ কথা বলে নিহতের পরিবার ও উত্তপ্ত বামনগাছির মানুষকে কোনও রকমে সামাল দিলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বদলে গেল মুকুলবাবুর সুর।
আজ, রবিবার সৌরভের জন্মদিন। মিছিল করে মোমবাতি জ্বালিয়ে আজ তাঁর স্মরণসভা করবেন নিহতের পরিবার। সামিল হবেন বামনগাছির মানুষও। ওই স্মরণসভার আয়োজন করেছে ‘সৌরভ প্রতিবাদী মঞ্চ।’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্রাথমিক ভাবে এটির নাম ছিল ‘বামনগাছি প্রতিবাদী মঞ্চ’। কিন্তু পরে তা বদলে সৌরভের নামেই রাখা হয়। কেন? সৌরভের দাদা সন্দীপ চৌধুরীর কথায়, “বামনগাছি প্রতিবাদ মঞ্চে’র মধ্যে এমন অনেকে ঢুকে পড়ছিলেন, যাঁদের আমরা চিনি না। তাঁরা কী করেন, জানি না। প্রতিবাদের আড়ালে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই।” মঞ্চের এক সদস্য বলেন, “প্রতিবাদের নামে দুষ্কৃতীদের কিছু মদতদাতাও মঞ্চে সামিল হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। রাজনীতি করে আমাদের প্রতিবাদ নষ্ট করে দেওয়াই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। তাই এই নাম বদল।”
রবিবারের সভায় ডাকা হয়েছে কামদুনি ও সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যদের, যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে দোষীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। পরের দিন, সোমবার সৌরভের খুনিদের শাস্তি চেয়ে ও এলাকায় সমাজবিরোধী কাজকর্ম বন্ধের দাবিতে পদযাত্রা করবে বামনগাছি-দত্তপুকুর এলাকার স্কুলের ছেলেমেয়েরা। তার প্রস্তুতি হিসেবে তৈরি হয়েছে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড।
তাতে লেখা, ‘সৌরভের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি চাই না। খুনির মদতদাতাদের ধরতে হবে।’
কিন্তু তবুও রাজনীতি বন্ধ হচ্ছে কি? যশোহর রোড ধরে বামনগাছি ঢুকলে মনে হবে, নির্বাচন দোরগোড়ায়! তৃণমূলের সভা উপলক্ষে বামনগাছি মোড় থেকে সৌরভের বাড়ি ঢোকার রাস্তা শুক্রবারই মুড়ে দেওয়া হয়েছিল দলীয় পতাকায়, যেমন ভাবে এক সময় তৃণমূলের পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল কামদুনি।
রাজনীতির লোকজনের আসা-যাওয়ার মধ্যেই এ দিন সৌরভের বাড়িতে গিয়ে সরোজবাবুর সঙ্গে দেখা করেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা অনিল মণ্ডল। তাঁর কোনও রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সেখানকার বাসিন্দারা জানেন, এ বছরের ৩ মার্চ বুকে পাথর বাঁধা অবস্থায় জলঙ্গি নদী থেকে পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ১৭ বছরের ছেলে অতনুর দেহ। পুলিশ-প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেও কোনও সুরাহা পাননি অনিলবাবু। ছেলের খুনিরা শাস্তি পায়নি এখনও। সেই কষ্ট আর হতাশা নিয়েই এক পুত্রহারা বাবা আর এক পুত্রহারা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বামনগাছিতে।
ছেলের দেহ পাওয়ার পরে এই প্রথম সরোজবাবু কারও সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা বললেন। কাঁদলেন। দু’জনেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy