Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুরসভায় ঘুষের সিন্ডিকেট প্রণবের

‘কর্তারা ওঁকে কেউ কিছু বলতেন না’

বাড়ির একেবারে গা ঘেঁষে বহুতল উঠছিল। প্রতিবাদ করে পুরসভায় পরপর দু’বার লিখিত অভিযোগ করেছিলেন লিলুয়ার বাসিন্দা কমলকুমারী কুণ্ডু। তাঁর অভিযোগ, বালি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ী তাতে কান তো দেনইনি।

বিচার ভবনের পথে প্রণব (বাঁ দিকে) এবং তন্ময় অধিকারী।-নিজস্ব চিত্র।

বিচার ভবনের পথে প্রণব (বাঁ দিকে) এবং তন্ময় অধিকারী।-নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস দাশ ও শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

বাড়ির একেবারে গা ঘেঁষে বহুতল উঠছিল। প্রতিবাদ করে পুরসভায় পরপর দু’বার লিখিত অভিযোগ করেছিলেন লিলুয়ার বাসিন্দা কমলকুমারী কুণ্ডু। তাঁর অভিযোগ, বালি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ী তাতে কান তো দেনইনি। উল্টে তাঁকে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারীর সঙ্গে।

লিলুয়ার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ২১ নম্বর ভুজঙ্গ ধর রোডের বাসিন্দা ওই মহিলা দাবি করছেন, চেয়ারম্যানের কথা মতো তিনি প্রণববাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে হুমকি দিয়ে ওই ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন, ‘কোনও প্রতিবাদ চলবে না। আমার নির্দেশেই ওই বহুতল হচ্ছে।’ এর পরে পুলিশের কাছেও গিয়েছিলেন ওই মহিলা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘থানায় যাওয়ার পরদিনই একদল দুষ্কৃতী এসে হুমকি দিয়ে যায়।’’

শুধু কমলকুমারী নন, প্রণব গ্রেফতার হওয়ার পরে এ রকম নানা অভিযোগই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, স্থানীয় স্তরের বিভিন্ন দলের নেতা থেকে পুরসভার বিভিন্ন দফতরের কর্তা, ভূমি দফতর, পুলিশ, দুষ্কৃতী সবাইকে নিয়ে রীতিমতো ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করেছিলেন প্রণব। প্রত্যেকের কাছেই মাসের নির্দিষ্ট তারিখে পৌঁছে যেত ‘মাসোহারা’।

রাজ্য দুর্নীতিদমন শাখার তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, লিলুয়া এলাকায় একটি একতলা বাড়ি কিংবা এক কাঠা জমি কিনতে গেলেও প্রণবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। তিনিই জমির নামপত্তন (মিউটেশন), পরচা, খাজনা— সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতেন। পাশাপাশি নিজের ‘পেটোয়া’ এলবিএসদের (লাইসেন্সড বিল্ডিং সার্ভেয়ার) দিয়ে ‘সাইট প্ল্যান’ তৈরি করিয়েও দিতেন। সরকারি নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বাড়ির নকশা তৈরির জন্য বর্গফুট পিছু ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মজুরি নিয়ে থাকেন এলবিএস-রা। কিন্তু পুলিশ সূত্রের খবর, প্রণবের ঘনিষ্ঠ এলবিএস-রা নিতেন বর্গফুট পিছু ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, এর থেকে মোটা কমিশন চলে যেত প্রণবের সিন্ডিকেটের হাতে।

এ তো গেল ছোট বাড়ি-জমির কথা। এলাকার বড় প্রোমোটাররাও ওই ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে তাঁদের কাজ এক চুলও এগোত পারতেন না বলেই তদন্তে জেনেছে দুর্নীতি দমন শাখা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, লিলুয়া এলাকায় বড় কোনও বহুতল তৈরির জন্য বেশি মাথা ঘামাতে হতো না প্রোমোটরদের। তাঁরা শুধু জমি কিনে প্রণবের শরণাপন্ন হতেন। মোটা টাকার ‘প্যাকেজ’-এর বিনিময়ে ‘সাইট প্ল্যান’ জমা দেওয়া থেকে শুরু করে জমির চরিত্র বদল করা, খাজনা কমানো, কোনও বেআইনি বিষয়ের অনুমোদন করানো, এমনকী ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের ব্যবস্থাও করে দিতেন প্রণব। নকশা অনুমোদনের জন্য কাঠা পিছু এক থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার হিসেব অবশ্য আলাদা ভাবে নেওয়া হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বালি পুরসভার এক অফিসার বলেন, ‘‘ওঁকে কেউ কিছু বলতেন না। কেন বলতেন না, তা বলতে পারব না। বেশির ভাগ সময়েই দেখতাম বহুতল তৈরির পরে তার নকশা পুরসভায় জমা পড়ত। আর কর্তারাও তা মেনেও নিতেন।’’ পুরসভার কর্মীদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, পুর-কর্তাদের প্রশ্রয় ছাড়া প্রণবের মতো এক জন সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের এই দাপট তৈরি হওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁদের অভিযোগ, প্রাক্তন পুরকর্তারা কোনও মতেই এই বেনিয়মের দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, একটি বহুতলের নকশা অনুমোদনের আবেদন করা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নকশা হাতে পাওয়া পর্যন্ত অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের উপরে আরও অনেক ধাপ থাকে। সেই প্রতিটি ধাপে থাকেন ঊর্ধ্বতন অফিসার ও পুরকর্তারা।

বাড়ি তৈরির জন্য কী কী ধাপ টপকাতে হয় কোনও নির্মাণকারীকে?

পুরসভার বিল্ডিং বিভাগ সূত্রের খবর, প্রথমে এলবিএসদের দিয়ে জমির ‘সাইট প্ল্যান’ করিয়ে নির্দিষ্ট আবেদন পত্র (ফর্ম-এ) পূরণ করে জমা দিতে হয়। এরপরে সেটি বিল্ডিং বিভাগ থেকে পাঠানো হয় অ্যাসেসমেন্ট বিভাগে। সেখানে জমির চরিত্র-সহ অন্যান্য বিষয় পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এর পরে অ্যাসেসমেন্ট বিভাগের রিপোর্ট চলে যায় সংশ্লিষ্ট সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। ওই ইঞ্জিনিয়ার সেই রিপোর্ট পরীক্ষা করে তা প্রাথমিক অনুমোদনের জন্য চেয়ারম্যান পারিষদ (পূর্ত) এর কাছে পাঠান। চেয়ারম্যান পারিষদ সেটি ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে পাঠালে তিনি তাতে অনুমোদন দিয়ে থাকেন। এর পরে আবেদনকারীর কাছে অনুমোদনের চিঠি যায় পুরসভা থেকে। সেই চিঠি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে বিল্ডিংয়ের নকশা জমা দিতে হয়। সেই নকশা সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করে পাঠান চেয়ারম্যান পারিষদের কাছে। পরে সেই বিষয়টি চেয়ারম্যান পারিষদের বৈঠকে পেশ করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এই সবের মাঝেই খাজনা, মিউটেশন, অ্যাসেসমেন্ট-সহ নানা বিভাগে নির্দিষ্ট ফি জমা দিতে হয়। এতগুলি ধাপ পেরিয়ে তবেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়।

তা হলে প্রণববাবুর গ্রেফতারের পরে এই সব ধাপগুলির দায়িত্বে থাকা অফিসার বা পুরকর্তারা কি তাঁদের দায় এড়াতে পারেন? পুরকর্মীরাই বলছেন, ‘‘জমি কিংবা বহুতলের মধ্যে কোনও বেনিয়ম থাকলে তা তো নকশার আবেদন থেকে চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত যে পদ্ধতি রয়েছে, তাতেই ধরা পড়ার কথা।’’ কিন্তু নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলে প্রাক্তন পুর কর্তারা বলছেন, ‘‘সমস্ত কিছু রাজনৈতিক চক্রান্ত!’’ আর অফিসাররা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন।

এখন রাজ্য দুর্নীতিদমন শাখার পাশাপাশি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-ও (ইডি) বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছে। ওই ঘটনায় করা পুলিশের এফআইআর-এর কপি চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনস্থ এই তদন্তকারী সংস্থা। ইডি-র তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে প্রণবকেও জেরা করা হবে। ইডি সূত্রের খবর, এত টাকা প্রণববাবু কোথা থেকে পেলেন, এর সঙ্গে বিদেশে টাকা পাচারের কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না, হাওয়ালা মারফত এই টাকা এসেছে কি না সেই সব তথ্য খতিয়ে দেখতে চান ইডি অফিসারেরা।

এ দিন প্রণব অধিকারী ও তাঁর ছেলে তন্ময়কে কলকাতার নগর দায়রা আদালতের অতিরিক্ত জেলা বিচারক সঞ্চিতা সরকারের এজলাসে হাজির করানো হয়। সরকারি আইনজীবীর আর্জি মেনে তাঁদের ১২ দিন পুলিশি হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। পাঁচটি ব্যাঙ্ক থেকে প্রণবের ১৫টি অ্যাকাউন্ট এ দিন সিল করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE