Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দিল্লির দরবারেও শিল্প-বিড়ম্বনা

সরকারি সভার মঞ্চ থেকে প্রায়শই এই সংস্থার কর্ণধারকে ডেকে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। দর্শকাসনে তাঁকে দাঁড় করিয়ে ঘোষণা করেন, তৃণমূল জমানাতেই পশ্চিম মেদিনীপুরের গোদাপিয়াশালে তৈরি হয়েছে তাঁদের সিমেন্ট কারখানাটি।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৮
Share: Save:

সরকারি সভার মঞ্চ থেকে প্রায়শই এই সংস্থার কর্ণধারকে ডেকে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। দর্শকাসনে তাঁকে দাঁড় করিয়ে ঘোষণা করেন, তৃণমূল জমানাতেই পশ্চিম মেদিনীপুরের গোদাপিয়াশালে তৈরি হয়েছে তাঁদের সিমেন্ট কারখানাটি। আর বিরোধীরা বলেন, ওই সিমেন্ট কারখানার মতো একটি-দু’টি কুমিরছানা দেখিয়েই রাজ্যে শিল্পের বেহাল দশাটা চাপা দেওয়ার প্রয়াস চালান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ দিল্লির ‘ইন্ডিয়া ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এ সেই ডালমিয়া ভারত সিমেন্টের ডিরেক্টর তথা সিইও আমনদীপের প্রশ্নের মুখেই প্রবল অস্বস্তিতে পড়লেন রাজ্যের শিল্পসচিব কৃষ্ণ গুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত দাম নিয়ে খোলাখুলি অসন্তোষ জানালেন এই শিল্প কর্তা।

বিদেশের সরকারি তহবিল ও পেনশন তহবিল পরিচালনকারী সংস্থাগুলির সামনে এ দেশে পরিকাঠামোয় দীর্ঘমেয়াদি লগ্নির সম্ভাবনা তুলে ধরতে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল অর্থ মন্ত্রক। আরও কয়েকটি রাজ্যের পাশাপাশি তাতে যোগ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। আজ হাতে গোনা কয়েক জন বিনিয়োগকারীর সামনে রাজ্যের হয়ে ‘প্রেজেন্টেশন’ দিচ্ছিলেন শিল্পসচিব-সহ দফতরের কর্তারা। সেখানেই আমনদীপ অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুতের দাম অন্য রাজ্যের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। সিমেন্টের মতো শিল্পে যথেষ্ট বিদ্যুৎ দরকার হয়। সেখানে এ এক বড় সমস্যা। আমনদীপের প্রশ্ন, তাঁদের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে এসে সিমেন্ট কারখানায় কেন ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না? কেন বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কারখানা চালাতে হচ্ছে?

গোদাপিয়াশালের ওই কারখানা উদ্বোধন করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। ডালমিয়া ভারত সিমেন্টের কর্তার প্রকাশ্যে উদ্বেগ জানানোটা তাই তাৎপর্যপূর্ণ। আমনদীপকে কোনও সমাধান দিতে পারেননি শিল্পসচিব। উল্টে তিিন মেনে নিয়েছেন, যে হেতু রাজ্যের একটি এলাকায় একটি সংস্থাকেই বিদ্যুৎ বণ্টনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাই তাদের থেকে বিদ্যুৎ কিনতে শিল্প সংস্থাগুলি বাধ্য। নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে এসে কারখানায় ব্যবহারের অনুমতি রাজ্যে দেওয়া হয় না। আর বিদ্যুতের চড়া দামের পক্ষে শিল্পসচিবের যুক্তি, উৎপাদন খরচ অনুযায়ীই বিদ্যুতের দাম ঠিক হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ মানের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ মেলে।

এক দিকে যেমন আমনদীপ, অন্য দিকে তেমন বহুজাতিক সংস্থা মর্গান স্ট্যানলি-র উচ্চপদস্থ কর্তা সৌরভ অগ্রবাল। শিল্পসচিবের কাছে তিনি জানতে চান, শিল্পে স্থানীয় শ্রমিক সমস্যা নিয়ে কী ভাবছে নবান্ন? বালির দ্বিতীয় বিবেকানন্দ সেতুতে লগ্নি করেছে মর্গান স্ট্যানলি। সৌরভের অভিযোগ, তাঁদের শুধু শ্রমিক সমস্যার মুখেই পড়তে হয়নি, সংস্থার জমিও জবরদখল হয়ে যাচ্ছে।

শ্রমিক বিক্ষোভ নিয়ে শিল্পমহলের অসন্তোষ নতুন নয়। ভদ্রেশ্বরে নর্থ ব্রুক জুট মিলে শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যে সিইও হরিকিষান মহেশ্বরীর খুনের ঘটনা এখনও টাটকা। আজ কার্যত সেই পুরনো ক্ষতেই নুন ছিটিয়েছেন বহুজাতিক সংস্থার কর্তা।

শ্রম-অসন্তোষ প্রসঙ্গে শিল্পসচিব বলেছেন, ‘‘যখনই এই ধরনের সমস্যা আসে, আমার স্তর থেকেই হস্তক্ষেপ করি।’’ তবে জবরদখলের সমস্যা যে মূলত আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা, তা মেনে নিয়েছেন শিল্পসচিব। বলেছেন, ‘‘এই ধরনের সমস্যা এলে সরকার অবশ্যই সমাধানের চেষ্টা করবে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে বলা হয়েছে, এ সব বরদাস্ত করা হবে না।’’ যদিও শিল্পমহলের অনেকেই এই আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না। তাঁদের মতে, যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সিন্ডিকেেটর রমরমা বন্ধ হয় না, সেখানে জমি জবরদখল বা শ্রমিক সমস্যার সহজ সমাধান মিলবে— এমন ভাবার কারণ নেই।

সিন্ডিকেটের মতো জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন, অধিগ্রহণে রাজ্যের অনীহার মতো বিষয়গুলিও যে শিল্পক্ষেত্রে রাজ্যের দফারফা করছে, তা গত পাঁচ বছরেও মানতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে লগ্নির ক্ষেত্রে রাজ্যের ভাবমূর্তি কোথায় ঠেকেছে, আজকের সম্মেলন যেন ছিল তারই বিজ্ঞাপন।

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া গুজরাত, কর্নাটক, অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশ এবং পঞ্জাব যোগ দিয়েছে ওই সম্মেলনে। কিন্তু আজ বিকেলে যখন একই সময়ে পাশাপাশি দু’টি হল-এ গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গের ‘প্রেজেন্টেশন’ চলছে, তখন দেখা গেল, গুজরাতের কথা শোনার জন্য ভিড় উপচে পড়ছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের হল-এ শ্রোতা মেরেকেটে জনা পনেরো। অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে লগ্নিকারীদের আলাপ-আলোচনা চলেছে নির্ধারিত সময়ের পরেও। আর রাজ্যের শিল্প দফতরের কর্তাদের পাট গোটাতে হয়েছে বরাদ্দ সময়ের বহু আগেই। বস্তুত, ডালমিয়া ভারত সিমেন্টের আমনদীপ এবং মর্গান স্ট্যানলির সৌরভ অগ্রবাল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের শিল্পসচিবকে আর কেউ কোনও প্রশ্নই করেননি!

এমন অস্বস্তির আবহেই অবশ্য শিল্পসচিবের দাবি, সরকারের হাতে যথেষ্ট জমি আছে। শিল্পোন্নয়ন নিগমের সমস্ত শিল্প পার্কে আগামী তিন বছর জমির দাম একই থাকবে। রাজারহাট-নিউটাউনে মোনোরেলের পরিকল্পনা হচ্ছে। এমনকী স্মার্ট সিটিগুলির পরবর্তী তালিকায় রাজারহাট-নিউটাউন এবং সল্টলেকের থাকার ব্যাপারে তিনি আশ্বাস পেয়েছেন বলে দাবি করেন শিল্পসচিব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE