Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

মত্ত এসইউভির ধাক্কায় বলি স্কুলছাত্র ও মা

কিন্তু সোমবার বিকেলে তাদের কলরব থামিয়ে দিল উদ্দাম গতিতে ধেয়ে আসা একটি এসইউভি। পলক ফেলতে না-ফেলতেই গাড়িটা পিষে দিল কয়েক জন পড়ুয়া আর স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু অভিভাবককে। তার পরে সটান একটি বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মেরে থেমে গেল।

দুর্ঘটনার পরে জনরোষে গাড়ি ভাঙচুর। নিজস্ব চিত্র

দুর্ঘটনার পরে জনরোষে গাড়ি ভাঙচুর। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩
Share: Save:

স্কুল সবে ছুটি হয়েছে। কলকলিয়ে বেরোচ্ছে কচিকাঁচারা। যেমন রোজ বেরোয়।

কিন্তু সোমবার বিকেলে তাদের কলরব থামিয়ে দিল উদ্দাম গতিতে ধেয়ে আসা একটি এসইউভি। পলক ফেলতে না-ফেলতেই গাড়িটা পিষে দিল কয়েক জন পড়ুয়া আর স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু অভিভাবককে। তার পরে সটান একটি বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মেরে থেমে গেল।

মুহূর্তে বদলে গেল স্কুল-শেষের আনন্দধ্বনি। ছুটির কলকাকলির জায়গা নিল আর্তনাদ, কান্না, বিলাপ এবং শোকের হাহাকার। খুদেদের ছটফটানির ছবিটা বদলে গিয়ে পড়ে রইল দলা পাকানো কিছু শরীর, রক্ত, ছোট ছোট জুতো, নিঃসঙ্গ স্কুলব্যাগ।

দক্ষিণ শহরতলির ঠাকুরপুকুরের কাছে রসপুঞ্জ মোড়ে বাখরাহাট রোডে ওই দুর্ঘটনায় স্কুলপড়ুয়া একটি ছেলে এবং তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। মৃত স্কুলপড়ুয়ার নাম অভিজিৎ সর্দার (৭) এবং তার মায়ের নাম সুলেখা দেবী (৪০)। দুর্ঘটনাটি জ্ঞানদাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে ঘটলেও অভিজিৎ ছিল তার লাগোয়া রসপুঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। বাসিন্দাদের দাবি, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। যদিও পুলিশের বক্তব্য, অভিভাবক ও পড়ুয়া মিলিয়ে গুরুতর আহতের সংখ্যা সাত। তবে তারাও স্বীকার করছে, মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে।

পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার এই ধরনের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না-ঘটে, সেই ব্যাপারে প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’’ পরিবহণমন্ত্রীর দাবি, দুর্ঘটনা আগের তুলনায় কমেছে। তবে এ দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ কলেজ স্ট্রিটে বেপরোয়া সরকারি বাসের ধাক্কায় এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন এক পুলিশ কনস্টেবল-সহ চার জন। ঘাতক বাসটি ফুটপাথের কয়েকটি দোকানেরও ক্ষতি করেছে। এ দিনই দুপুরে কৈখালির কাছে ভিআইপি রোডে বারাসত-গড়িয়া রুটের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারায় চালক ও খালাসি-সহ চার জন আহত হয়েছেন।

ঠাকুরপুকুরের কাছে রসপুঞ্জ মোড়ে দুর্ঘটনার পরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। প্রবল আক্রোশে তারা ওই ছাইরঙা গাড়িটি উল্টে ফেলে তার উপরে চড়ে লোহার রড ও থান ইট মেরে ভাঙচুর করে।

ক্ষিপ্ত জনতার অভিযোগ, স্থানীয় এক যুবক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোয় এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই যুবক অবশ্য দুর্ঘটনার ঠিক পরেই গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যায়। গাড়িতে তিন আরোহীও ছিলেন। তাঁরাও পালিয়ে যান। তাঁদের না-পেয়ে প্রথমে জনতার রাগ গিয়ে পড়ে গাড়িটার উপরে। আর তার পরে জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ।

ঘটনাস্থল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর থানা এলাকায়। ঠাকুরপুকুর বাজার থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। শুধু বিষ্ণুপুর থানা নয়, আশপাশেরও কয়েকটি থানার পুলিশ গঙ্গাসাগরে গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। দুর্ঘটনা ও গাড়ি ভাঙচুরের খবর পেয়ে প্রথমে ১৪-১৫ জন পুলিশকর্মী আসেন। তাঁরা শান্তি বজায় রাখতে বলায় জনতা আরও খেপে যায়। তত ক্ষণে লাগোয়া তল্লাটের বিশাল জনতা জড়ো হয়েছে সেখানে। তাদের ছোড়া ইটপাটকেলের মুখে পিছু হটে পুলিশ।

কিছু ক্ষণের মধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশের সদর দফতর আলিপুর থেকে বিশাল পুলিশবাহিনী চলে আসে। উল্টে যাওয়া গাড়ি সরিয়ে বাখরাহাট রোড পরিষ্কার করতে পৌঁছে যায় দমকলও। কিন্তু তাতে জনতার ক্ষোভের আগুন আরও বেশি করে জ্বলতে থাকে। পুলিশের তিনটি এবং দমকলের একটি গাড়ি, একটি বাস, একটি লরি ও দু’টি ডাম্পার ভাঙচুর করা হয়। সেই সঙ্গে চলে পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছোড়াছুড়ি। ফের পুলিশের দিকে ধেয়ে যায় জনতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠি উঁচিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ।

বিপুল সংখ্যক মানুষ এতটাই রাগে কার্যত উন্মত্ত ছিলেন যে, তাঁদের হটাতে পুলিশকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায় পুলিশ ও ক্ষিপ্ত জনতার মধ্যে। ঘণ্টা দেড়েক অশান্তি চলার পরে, বিকেল ৫টা নাগাদ অবস্থা কিছুটা থিতু হয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, মদ্যপ অবস্থায় যে-যুবক উদ্দাম গতিতে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার নাম কাল্লু মোল্লা। ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে বনগ্রাম তল্লাটে তার বাড়ি। ঘাতক এসইউভি তার বাবার নামে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই রসপুঞ্জ মোড়কে বলা যায় ‘স্কুল জোন’। জ্ঞানদাময়ী বালিকা বিদ্যালয় ছাড়াও আশপাশে ছড়িয়ে খান তিনেক স্কুল। বছর বিশের কাল্লুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রায় রোজ বিকেলে স্কুল-ছুটির সময়ে সে গাড়ি নিয়ে এসে মেয়েদের স্কুলের সামনে য়এবং ছাত্রীদের উত্যক্ত করে। এ দিনও সেটাই করছিল। দুর্ঘটনাস্থলের ২০ মিটার দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল তাদের গাড়ি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেরই বক্তব্য, কাল্লু এ দিন মদ্যপ অবস্থায় ছিল। নেশার ঘোরে উল্টোপাল্টা বকছিল। ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারছিল না।

পুলিশ জেনেছে, ছুটির ঘণ্টা বাজার পরে তখন পড়ুয়ারা এক এক করে বেরোচ্ছে। কাল্লু কিছু ক্ষণ স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের কটূক্তি করার পরে হঠাৎই চালকের আসনে বসে। তখন স্থানীয় এক কাঠমিস্ত্রি তাকে বাধা দিতে যান। কিন্তু কাল্লু তাঁকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। তার পরেই সে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। কয়েক মুহূর্তে সব শেষ।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, সব ‘স্কুল জোন’-এর বেশ কিছুটা আগে থেকেই রাস্তার উপরে গাড়ির গতি কমানোর নির্দেশ সংবলিত বোর্ড থাকে। রসপুঞ্জে সে-সব কিছু নেই। অথচ বাখরাহাট রোড একটি ব্যস্ত রাস্তা। চার-চারটি স্কুলের কাছে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক পুলিশ তো দূরের কথা, কোনও সিভিক ভলান্টিয়ারও নেই। কোনও হাম্পও তৈরি করা হয়নি রাস্তায়। স্কুলের আশেপাশে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জেরে দুর্ঘটনা নতুন নয়। প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই এত বড় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশের এক কর্তার দাবি, রসপুঞ্জ মোড়ে যে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে, সেটা তাঁদের জানানো হয়নি। ওই অফিসার বলেন, ‘‘কাল্লু মোল্লা যে স্কুলের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত, সেই ব্যাপারেও আগে কখনও কোনও অভিযোগ পাইনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Road Accident Reckless Driving Dead
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE