সাধারণ মানুষের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে যিনি অভিযুক্ত, এক সময়ে তিনিই নিজের সংস্থার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি আটকাতে আলাদা দফতর খুলে বসেছিলেন!
রোজ ভ্যালি কাণ্ডে এমনই তথ্য হাতে এসেছে সিবিআইয়ের। সূত্রের খবর, এই রাজ্যেরই এক অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসারকে মাথায় রেখে রোজ ভ্যালিতে ১৬ সদস্যের একটি ভিজিল্যান্স বিভাগ গঠন করেছিলেন গৌতম কুণ্ডু।
তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পেরেছে, সেই ভিজিল্যান্স বিভাগে গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার অভিযোগও জমা পড়েছিল। মূলত আমানতকারীরাই সেই সব অভিযোগে জানিয়েছিলেন, বহু এজেন্ট তাঁদের থেকে টাকা নিয়ে সংস্থার জাল শংসাপত্র হাতে ধরিয়ে দিতেন। পরে নিজেদের টাকা ফেরত আনতে গিয়ে গ্রাহকেরা জানতে পারেন, ওই শংসাপত্র জাল!
সিবিআইয়ের অভিযোগ, আমানতকারীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পাওয়ার পরেও রোজ ভ্যালির ভিজিল্যান্স বিভাগ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ হিসেবে তদন্তকারীদের যুক্তি, এই ধরনের সমস্যা যাতে বাইরে প্রকাশ না পায়, তাকে ধামাচাপা দেওয়া যায়, সেই কারণেই এই বিভাগটি তৈরি করেছিলেন গৌতম। গৌতমের সংস্থার ভিজিল্যান্স বিভাগের শীর্ষে বসা ওই অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার সে জন্যই এখন তদন্তকারীদের নজরে।
সুত্রের খবর, গৌতম-ঘনিষ্ঠ ওই অফিসার রোজ ভ্যালির অন্যতম পরামর্শদাতাও ছিলেন। তদন্তকারীদের কথায়, ‘‘যে সময়ে রোজ ভ্যালি বাজার থেকে বেআইনি ভাবে টাকা তুলছিল, সেই সময়ে রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ ওই অফিসার ধামাচাপা দিয়েছেন।’’
সিবিআই জানিয়েছে, সংস্থার নিজস্ব ‘ভিজিল্যান্স’ দফতরের কয়েক জন ম্যানেজারের বয়ান নেওয়া হয়েছে। ওই বয়ানের ভিত্তিতেই তাঁদের মনে হয়েছে, দুর্নীতি রোধ নয়, রোজ ভ্যালির কোনও কর্মী-অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে নানা কৌশলে তা মিটিয়ে ফেলাই ছিল ওই অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসারের কাজ। সিবিআইয়ের অভিযোগ, রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের একাধিক দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকার সুবাদে নিজের প্রভাব খাটিয়ে রোজ ভ্যালির বেআইনি ব্যবসার প্রসারে সহযোগিতাও করেছেন ওই অফিসার। যার বদলে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়েছেন তিনি।
সারদা-র সঙ্গে যুক্ত শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক প্রাক্তন আইপিএস অফিসারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছিল এবং তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। তিনি অবশ্য এখন জামিনে মুক্ত আছেন।
রোজ ভ্যালির একাধিক কর্মচারীর বয়ান অনুয়ায়ী, আমানতকারীদের কাছ থেকে যে টাকা তোলা হতো, এজেন্টদের তার থেকে ২০-২২ শতাংশ কমিশন দিত রোজ ভ্যালি। ২০১১ সালে বাজার থেকে টাকা তোলা বন্ধ করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় সেবি। অভিযোগ, তার পরেও রোজ ভ্যালির তিনটি সংস্থার নাম করে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তোলা হয়েছিল। তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার এজেন্টের নামে অভিযোগ জমা পড়েছিল সংস্থার ভিজিল্যান্স দফতরে। অভিযোগ ছিল, ডামাডোলের বাজারে বহু এজেন্ট আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংস্থার জাল রসিদ অথবা সার্টিফিকেট বিলি করে সেই টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই সব অভিযাগ রোজ ভ্যালির ভিজিল্যান্স দফতরে জমা পড়লেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০১১ সালের পর বাংলা, বিহার, ওড়িশা, অসম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড থেকে রোজ ভ্যালি প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা তুলেছিল বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। সেই টাকার মাত্র ১২ শতাংশ আমানতকারীরা ফেরত পেয়েছেন। বাকি টাকার অনেকটাই বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে তদন্তকারীদের হাতে তথ্য-প্রমাণ এসেছে। ওই অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসারও টাকা পাচারে জড়িত রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
বাজার থেকে বেআইনি ভাবে টাকা তোলার অভিযোগে রোজ ভ্যালি কর্তা গৌতম কুণ্ডু, ডিরেক্টর শিবময় দত্ত-সহ চার কর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রোজ ভ্যালির বেআইনি ব্যবসাকে মদত দেওয়া ও টাকা পাচারের অভিযোগে তৃণমূলের দুই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস পালকেও গ্রেফতার করেছে সিবিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy