Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রেম দিবসে নির্মম সাজা

আয়লার তাণ্ডবে ভেসে গিয়েছিল ঘরবাড়ি। হতদরিদ্র পরিবারের শেষ সম্বলটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। তারপরে পেটের টানে ভিন রাজ্যে যাওয়া। সেখানে কোনও মতে অন্নবস্ত্রের সংস্থান হয়। আর ওই পরিস্থিতিতেই নতুন করে প্রেম বাসা বাঁধে দুই পরিবারের নারী-পুরুষের মনে। সমাজের নীতি-পুলিশরা যা মেনে নেয়নি। গ্রামে ফিরে এলে দু’জনকে মাথা নেড়া করে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে ঘোরানো হয়েছে রাস্তায়।

নির্মল বসু
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:২০
Share: Save:

আয়লার তাণ্ডবে ভেসে গিয়েছিল ঘরবাড়ি। হতদরিদ্র পরিবারের শেষ সম্বলটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। তারপরে পেটের টানে ভিন রাজ্যে যাওয়া। সেখানে কোনও মতে অন্নবস্ত্রের সংস্থান হয়। আর ওই পরিস্থিতিতেই নতুন করে প্রেম বাসা বাঁধে দুই পরিবারের নারী-পুরুষের মনে। সমাজের নীতি-পুলিশরা যা মেনে নেয়নি। গ্রামে ফিরে এলে দু’জনকে মাথা নেড়া করে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে ঘোরানো হয়েছে রাস্তায়।

রবিবার সন্দেশখালির বেড়মজুর ২ পঞ্চায়েতের ঝুপখালি গ্রামের ধুলিয়াপাড়ার এই ঘটনা অবশ্য থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়নি। গোটা বিশ্ব যে দিনটিকে প্রেমের দিন হিসাবে মর্যাদা দিয়েছে, সে দিন একদল গ্রামবাসীর এমন মধ্যযুগীয় আচরণে নিন্দার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে থাকলেও দুই পূর্ণ বয়স্ক নারী-পুরুষের সঙ্গে এমন বর্বরোচিত আচরণ মেনে নিচ্ছেন না স্থানীয় বিধায়ক নিরাপদ সর্দার। তিনি বলেন, ‘‘কোন জগতে বাস করছি আমরা। পুলিশকে বলা হয়েছে, যারা এ ভাবে দু’জনকে মাথা মুড়িয়ে গ্রামে ঘোরাল, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে।’’ উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) গৌরভ লাল বলেন, ‘‘বিষয়টি শুনেছি। তবে কেউ এখনও লিখিত অভিযোগ করেনি। তা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বসিরহাটের মহকুমাশাসক নীতেশ ঢালি বলেন, ‘‘যদি কেউ অন্যায় করে থাকে, তবে তা দেখবে পুলিশ-প্রশাসন। এ ভাবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ব্লক প্রশাসন স্তরে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’’

তবে যে দুই মহিলা-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে বিবাদ, সেই দু’জন কিন্তু দিনের শেষে নিজের নিজের পরিবারের সঙ্গেই ঘরে ফিরেছেন।

প্রেমের ‘পবিত্রতা’র ধ্বজা ওড়াচ্ছেন যাঁরা, সেই কমলা সর্দার, সবিতা সর্দার, ফুলেশ্বরী সর্দার, শ্যামলী সর্দারদের বক্তব্য, ‘‘দু’জনেই বিবাহিত। সন্তান আছে। তা সত্ত্বেও তাদের দেখভাল না করে স্বামী-স্ত্রীর মতো এক সঙ্গে থাকছে, এটা অনৈতিক। গ্রামের কেউ মানতে রাজি নয়। বার বার সাবধান করলেও কোনও ফল হয়নি। তাই এমন শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম, যাতে আর কেউ কখনও ভুল করেও এমন ঘটনা না ঘটায়।’’

কিন্তু অনৈতিক কিছু ঘটে থাকলে পুলিশ-প্রশাসন তো আছে, তাদের কাছে দরবার করলেন না কেন?

আদিবাসী সমাজের ওই মহিলাদের বক্তব্য, একের পর এক ধর্ষণ হচ্ছে, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ক’টা খবর রাখে পুলিশ। ক’জনই বা শাস্তি পাচ্ছে। তাই নিজেদের হাতে দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, বেড়মজুর এলাকার ওই দু’টি আদিবাসী পরিবারই আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সম্পর্কে তারা আবার আত্মীয়। পরে সপরিবার ভিনরাজ্যে চলে যায় পরিবার দু’টি। গ্রামবাসীদের দাবি, পরে বাকিরা ফিরে এলেও এক পরিবারের কর্তা এবং অন্য পরিবারের বধূটি ফেরেননি। জানা যায়, তাঁরা বেঙ্গালুরুতে কাজ করেন। বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। বছর দু’য়েক আগে দু’জন একবার ফিরেছিলেন গ্রামে। সালিশি সভা বসে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এ বার থেকে ওই মহিলাকে গ্রামে তাঁর স্বামী-সন্তানকে নিয়ে থাকতে হবে। একই ভাবে নিজের পুরনো পরিবারে ফিরতে হবে আর এক ওই যুবককেও। কিন্তু সেই ফতোয়ার তোয়াক্কা করেনি দু’জনের প্রেম। বাড়ি ছেড়ে পালান তাঁরা।

এরপর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছিল গ্রাম। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় দু’জনে ফেরেন গ্রামে। খবর পেয়ে শনিবার ব্যান্ডেল থেকে ফেরেন ওই যুবকের স্ত্রী-ও। দেখেন, তাঁর বাড়িতে অন্য এক মহিলাকে নিয়ে আছেন তাঁর স্বামী। বাইরে থেকে দরজার শিকল তুলে পাড়ার মহিলাদের খবর দেন তিনি।

সকলে এসে দু’জনকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে মাথা নেড়া করে। মুখে চুন-কালি লেপে দেওয়া হয়। গলায় পরানো হয় জুতোর মালা। এ ভাবেই দু’জনকে ঘোরানো হয় গ্রামের রাস্তায়। পিছনে পিছনে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে ঘোরে গ্রামের পুরুষ-মহিলারা। শনিবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে এই কাণ্ড। পরে ছাড়া পেয়ে ওই দু’জন আশ্রয় নেন একটি সরস্বতী পুজোর মণ্ডপে।

ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে থাকেন সন্দেশখালি পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি সামসুদ্দিন সাহাজি। তিনি বলেন, ‘‘ওঁদের দু’জনের মেলামেশা গ্রামের পাঁচজন ভাল চোখে দেখেননি। বারণ করা সত্ত্বেও ওই দু’জন গ্রামে লোকের কথায় কান দেননি।’’ তাঁর মতে, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে যে ভাবে হেনস্থা করা হল দু’জনকে, তা যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনই দিনের পর দিন লোকের চোখের সামনে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়াটাও বরদাস্ত করা যায় না। তাঁর দাবি, খবর পেয়ে দ্রুত সকলকে বুঝিয়ে যে যার ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমস্ত ঘটনার কথা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

মহিলাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও কথা বলেননি। তবে তাঁর সঙ্গীর কথায়, ‘‘আমাদের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক আছে, এটা ঠিক। কিন্তু অনৈতিক কিছু করিনি। বিয়েও করিনি। এ কথা গ্রামের মহিলারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না। ওরা আমাদের উপরে অমানসিক অত্যাচার চালিয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Valentineday illicit punishment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE