Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

চমকদারির মান বাঁচানোর তাগিদে পরিষেবা ধরাশায়ী

পরিকল্পনার ভিত যদি বাস্তবের মাটিতে গাঁথা হয়ে না-থাকে, তা হলে প্রতি পদে ঠোক্কর খেতে হয়। যেমন খাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর। ‘প্রতিশ্রুতি’র চাপে তাদের বাস্তবিকই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’র ঠেলায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় মেডিক্যাল কলেজের! গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হোক বা জেলা হাসপাতাল— রাজ্যে সরকারি চিকিৎসার চালু পরিকাঠামোর মেরুদণ্ড যথেষ্ট দুর্বল।

উদ্বোধনের দিনেও অসম্পূর্ণ রয়েছে নয়াগ্রামের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল— ফাইল চিত্র

উদ্বোধনের দিনেও অসম্পূর্ণ রয়েছে নয়াগ্রামের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল— ফাইল চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

পরিকল্পনার ভিত যদি বাস্তবের মাটিতে গাঁথা হয়ে না-থাকে, তা হলে প্রতি পদে ঠোক্কর খেতে হয়। যেমন খাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর। ‘প্রতিশ্রুতি’র চাপে তাদের বাস্তবিকই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’র ঠেলায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় মেডিক্যাল কলেজের!

গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হোক বা জেলা হাসপাতাল— রাজ্যে সরকারি চিকিৎসার চালু পরিকাঠামোর মেরুদণ্ড যথেষ্ট দুর্বল। কিন্তু অভিযোগ, তাকে চাঙ্গা করে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উন্নত পরিষেবা জোগানোর দিকে সরকারের যত না নজর, তার চেয়ে বেশি তাগিদ চমক দিয়ে হাততালি কুড়ানোর। যে কারণে সাধ্যের প্রশ্নকে কুলুঙ্গিতে তুলে একের পর এক ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা। এবং যার মাসুল কড়ায়-গণ্ডায় গুনতে হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে। কী রকম?

স্বাস্থ্যভবনের খবর: রাজ্যের সিংহভাগ মেডিক্যাল কলেজে এমনিতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাড়ন্ত। এমতাবস্থায় একের পর এক ঘোষিত ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’র জন্য বিশেষজ্ঞ জোগাড় করতে কালঘাম ছুটছে। শেষমেশ হাত পড়ছে সেই মেডিক্যাল কলেজেরই চিকিৎসক-ভাঁড়ারে। ফলে সেখানকার চালু পরিষেবাও সঙ্কটে। উপরন্তু ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’তে বিশেষজ্ঞদের ‘ধরে রাখা’র স্বার্থে মোটা ভাতার টোপ ঝোলাতে হচ্ছে, যে বাবদ বাড়তি টাকা চেয়ে অর্থ দফতরের দ্বারস্থ হয়েছে স্বাস্থ্যভবন। কিন্তু আমজনতাকে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুত নিখরচার চিকিৎসা-পরিষেবা জোগাতে যে সরকার নাস্তানাবুদ, তাদের পক্ষে ওই বাড়তি খরচ মেটানো কতটা সম্ভব, সে প্রশ্নও এই মুহূর্তে যথেষ্ট প্রকট।

স্বাস্থ্যভবনের তথ্যানুযায়ী, রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে নানা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি হয়ে গেলেও চালু করা যায়নি। কারণ, ডাক্তার জোগাড় হয়নি। এ দিকে আসন্ন বিধানসভা ভোটের মুখে একটা-দু’টো করে ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’র ঝাঁপ খোলার পালা শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্যভবনের সিদ্ধান্ত, আপাতত নিকটবর্তী মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তুলে এনে সেখানকার আউটডোরে বসানো হবে। এতে অন্তত মুখটা বাঁচবে।

এবং সেই বিশেষজ্ঞেরা যাতে বেঁকে না-বসেন, সে জন্য ‘আকর্ষণীয়’ ভাতার বন্দোবস্ত হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সুপার স্পেশ্যালিটির আউটডোরে বসার জন্য অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের মতো সিনিয়রেরা দিনপিছু পাঁচ হাজার টাকা পাবেন। আর টিউটর (ডেমনস্ট্রেটর)-এর মতো তুলনায় জুনিয়রেরা দিনপিছু চার হাজার। এক জন মাসে সর্বোচ্চ দশ দিন ওই ডিউটি করতে পারবেন।

সেই হিসেবে এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের সামনে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বাড়তি রোজগারের পথ খুলে যাচ্ছে। টিউটরদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা চল্লিশ হাজার। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে নিত্য দিন অর্থাভাবের অনুযোগ, যেখানে ‘ফ্রি চিকিৎসা’র ঠেলায় স্বাস্থ্য দফতরের নাভিশ্বাস উঠছে, সেখানে এত বাড়তি টাকা আসবে কোথা থেকে?

সুশান্তবাবুর ক্ষুব্ধ জবাব, ‘‘আমরা কী ভাবে কী করব, আপনাদের ভাবতে হবে না। সব হয়ে যাবে।’’

অধিকর্তা জানিয়েছেন, বড়জোড়া ও নয়াগ্রাম দিয়ে নতুন বন্দোবস্ত শুরু হতে চলেছে। ক্রমশ সমস্ত সুপার স্পেশ্যালিটিতে তা চালু হবে। বড়জোড়ায় বিশেষজ্ঞ তুলে আনা হবে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে। একই ভাবে মেদিনীপুর মেডিক্যালের মেডিসিন ও সার্জারির বিশেষজ্ঞেরা গিয়ে নয়াগ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি’র আউটডোর চালাবেন। বাস্তব অবশ্য বলছে, দুই মেডিক্যাল কলেজেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে রোগীরা হামেশা অসুবিধায় পড়েন। যাঁরা আছেন, তাঁরাও এ বার সপ্তাহে দু’দিন সুপার স্পেশ্যালিটিতে গিয়ে বসলে চলবে কী করে?

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

সুশান্তবাবুর দাবি, ‘‘পালা করে গেলে অসুবিধে হবে না।’’ যদিও তাঁর দফতরের বড় অংশের ধারণা, সুপার স্পেশ্যালিটির মুখরক্ষা করতে গিয়ে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে পরিষেবা ও পঠন-পাঠন লাটে উঠবে। কেন? কারণ, ভাতার টানে মেডিক্যাল কলেজের কাজ শিকেয় তুলে অনেকে সুপার স্পেশ্যালিটির আউটডোরে ছুটবেন বলে তাঁদের আশঙ্কা। বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর মেডিক্যালের কর্তারা জানিয়ে রেখেছেন, তাঁদের পরিষেবার হাল এমনিতেই খারাপ। সুপার স্পেশ্যালিটির বোঝা চাপলে অথৈ জলে পড়তে হবে। ‘‘সবচেয়ে মার খাবে পড়াশোনা। এখনই নিয়মিত ক্লাস হয় না। তার উপরে ডাক্তারদের সামনে বাড়তি উপার্জনের এমন টোপ ঝুললে তো অনেকের দেখাই মিলবে না!’’— মন্তব্য বাঁকুড়া মেডিক্যালের এক কর্তার। মেদিনীপুর মেডিক্যালের এক প্রশাসকের কটাক্ষ, ‘‘ঠিকঠাক জায়গায় দরবার করলে নাকি কলকাতায় ভাল পোস্টিং পাওয়া যায়। এ বার তো দেখছি বাঁকুড়া-মেদিনীপুরে পোস্টিং নিতে হুড়োহুড়ি লেগে যাবে!’’

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্রান্ট ফান্ড’ (বিআরজিএফ)-এর আওতায় পশ্চিমবঙ্গে ৩৪টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হওয়ার কথা। এর বাইরে আরও সাতটা। সব মিলিয়ে ৪১টি! দিন কয়েক আগে নদিয়ার তেহট্টের প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রীও বলে এসেছেন, ‘‘দু’টো সুপার স্পেশ্যালিটি (নয়াগ্রাম, বড়জোড়া) চালু হল। জানুয়ারির মধ্যে আরও কুড়িটার উদ্বোধন হবে।’’

শুনে রীতিমতো প্রমাদ গুনছেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষেরা। দিন গুনছেন, কবে ওঁদের ডাক্তারদের সামনে সুপার স্পেশ্যালিটির ডাক আসে। কেউ কেউ এ-ও জানাচ্ছেন, মেডিসিন ও সার্জারি হচ্ছে গিয়ে একেবারে ‘স্পেশ্যালিটি’ বিষয়। আদৌ ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ কিছু নয়। সুপার স্পেশ্যালিটি ছাপ্পা মারা হাসপাতালে শুধু দু’টো স্পেশ্যালিটি আউটডোর খুলে সরকার ঠিক কী বোঝাতে চাইছে, তা-ও অনেকের মাথায় ঢুকছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE