রজত মজুমদার।
অল্প-স্বল্প বা মাঝারি গোছের কিছু নয়। বলতে গেলে ‘আকাশছোঁয়া’ বেতনে তিনি চাকরি করতেন। অথচ চাকরিস্থলে তাঁর কাজটা কী ছিল, সেটাই পরিষ্কার হচ্ছে না!
প্রাক্তন পুলিশকর্তা তথা তৃণমূল সহ সভাপতি রজত মজুুমদারের সারদা-সংশ্রবের শিকড় খুঁজতে গিয়ে এমনই ধন্ধে পড়ে গিয়েছে এসএফআইও (সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস, যারা কিনা গুরুতর জালিয়াতির তদন্ত করে থাকে)। কেন্দ্রীয় কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনস্থ বিভাগটির তদন্তকারীদের দাবি: সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ঠিক কী কাজের জন্য তাঁকে নিজের সংস্থায় মাসে সাত লক্ষ টাকার মাইনেতে বহাল করেছিলেন, রজতবাবু তার গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে এসএফআইও-ও নিজেদের মতো তদন্ত চালিয়েছিল। তদন্তের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সম্পর্কে তারা সম্প্রতি মন্ত্রকে সাড়ে পাঁচশো পাতার রিপোর্ট পেশ করেছে। রাজ্য পুলিশ তথা বিধাননগর কমিশনারেটের অসহযোগিতার ফলে তাদের তদন্ত কী ভাবে প্রতি পদে হোঁচট খেয়েছে, রিপোর্টে তার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সারদা-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সামনে আসা বিবিধ চরিত্রের প্রসঙ্গ। রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজতবাবু থেকে শুরু করে কলকাতা পুলিশের বর্তমান কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বা পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের নামও এসেছে। সুরক্ষা-বর্ম পাওয়ার তাগিদের পাশাপাশি এঁদের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব বিস্তার করাও সারদা-কর্ণধারের উদ্দেশ্য ছিল বলে এসএফআইও’র অনুমান।
সারদা-কাণ্ডে ইতিমধ্যে রজতবাবুকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। তিনি আপাতত জেলে। এবং তাঁর জন্য এসএফআইও’র রিপোর্টে বরাদ্দ হয়েছে তিনটি অনুচ্ছেদ। ১৮৭ নম্বর পাতায় সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর ‘সম্পর্ক’ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘সারদা রিয়েলটি সংস্থায় যোগদানের আগে রজত মজুমদার এক সংস্থায় নিরাপত্তা-উপদেষ্টা হিসেবে মাসে এক লক্ষ টাকা বেতন নিতেন। কীসের সুবাদে সারদায় তাঁর বেতন এক লাফে সাত গুণ হয়ে গেল, সেটা তিনি তদন্তকারীদের বোঝাতে পারেননি।’ সারদায় তিনি ঠিক কী কাজ করতেন, সে প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তরও রজতবাবু দিতে পারেননি বলে এসএফআইও’র দাবি।
একই সঙ্গে প্রাক্তন ডিজি’র পরস্পর-বিরোধী কথাবার্তাও কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের নজর এড়ায়নি। তাতে ধন্ধ ও সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। কী রকম?
এসএফআইও’র রিপোর্ট বলছে, ‘রজতবাবু এক বার দাবি করেছেন, সারদা কী ব্যবসা করত, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা ওঁর ছিল না। অথচ পরে উনি-ই জানিয়েছেন, সারদা গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক কৌশল রচনা ও পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ দিতেন!’ এসএফআইও-র এক অফিসারের কথায়, “সারদার চাকুরে হিসেবে রজতবাবু নির্দিষ্ট কোনও কাজ করেননি। জবানবন্দিতে সুদীপ্ত সেনও বলেছেন, রজতবাবুকে নিয়োগ করে সারদা গোষ্ঠীর কোনও কাজ হয়নি। এর উপরে রজতবাবুর বক্তব্যের অসঙ্গতি তাঁর প্রতি সন্দেহ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।” বস্তুত রিপোর্টে এসএফআইও’র দাবি, সারদার কারবার ছড়ানোর উদ্যোগে রজতবাবু বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই নিয়েছিলেন। ‘এমনকী, সারদার ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্র খুঁজতে উনি (রজতবাবু) আমেরিকার লাস ভেগাসে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন।’ বলা হয়েছে রিপোর্টের ১৮৮ নম্বর পাতায়।
এমতাবস্থায় এসএফআইও রজতের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত করার জন্য সিবিআইয়ের কাছে সুপারিশ করেছে। প্রসঙ্গত, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পেরেছে, রজতবাবু লাস ভেগাসে গিয়েছিলেন বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন করতে। তিনি ছিলেন সম্মেলনের আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান। ওই অনুষ্ঠানের পিছনে সারদা গোষ্ঠী টাকা ঢেকেছিল। এবং তখন (১৬ জানুয়ারি, ২০১২) ওই বঙ্গ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে রজতবাবুকে শুভেচ্ছাপত্র দেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেচ্ছাপত্রটি সিবিআইয়ের হাতে এসেছে।
এমন কিছু তথ্য ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে এসএফআইও’র পর্যবেক্ষণ, সুদীপ্ত সেন যে রজত মজুমদারকে বিপুল মাইনে দিয়ে রেখেছিলেন, তার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের ওই প্রাক্তন শীর্ষ কর্তাকে দিয়ে ‘প্রভাবশালীদের’ ছত্রচ্ছায়া আদায়। এবং একই লক্ষ্যে কখনও পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবু, কখনও বা পুলিশ কমিশনার সুরজিৎবাবুকে সারদার অনুষ্ঠান-মঞ্চে তোলা হয়েছে। এসএফআইও-র এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘সারদায় সিবিআই তলবের সময় সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছিল, কেলেঙ্কারির নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালীদের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে হবে। রিপোর্ট তৈরির সময় আমরাও কথাটা মাথায় রেখেছি।”
আলিপুর আদালতে সৃঞ্জয় বসু (টুম্পাই)।
সৃঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করতে আদালতে এলেন ব্যারেটো।
বুধবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
মদন মিত্রের সারদা-সংশ্রব প্রসঙ্গে এসএফআইও’র বক্তব্য কী?
এ ব্যাপারে তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষের দেওয়া কিছু ছবির উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। বলা হয়েছে, ‘কুণাল ঘোষ আমাদের বেশ কয়েকটি ছবি দিয়েছেন, যেখানে সারদা গ্রুপ অব কোম্পানিজের অনুষ্ঠান মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রকে দেখা যাচ্ছে।’ ১৯১ নম্বর পাতায় লেখা, ‘সারদা এমপ্লয়িজ প্রগ্রেসিভ ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে মদন মিত্রের উপস্থিতির ছবি কুণাল দিয়েছেন। তিনি আমাদের আর একটি ছবি দিয়েছেন, যেখানে সারদার অনুষ্ঠানে মঞ্চে অন্যদের সঙ্গে রয়েছেন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ।’
ওই সব নথি এখন চলে গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। রিপোর্টের ১৯২ নম্বর পাতায় এসএফআইও’র তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ‘আমাদের জোগাড় করা তথ্য-প্রমাণ আমরা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছি। কারণ, সেগুলো নিয়ে আর করার কিছু নেই। সিবিআই সারদা-কাণ্ডে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত করছে। আমাদের দেওয়া তথ্য তাদের কাজে লাগবে।’
উল্লেখ্য, মদনবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়ে সিবিআই ইতিমধ্যে নোটিস পাঠিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে পুলিশ কমিশনারকে তলবের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। “যে কোনও তদন্ত সংস্থার সুপারিশ আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে থাকি।” বলেছেন সিবিআইয়ের এক পদস্থ কর্তা। এসএফআইও-রিপোর্টের প্রেক্ষিতে পরিবহণমন্ত্রী বা পুলিশ কমিশনারের কী বক্তব্য?
মদনবাবু এ দিন বলেন, “আমি বা আমার পরিবারের কেউ কোনও চিটফান্ডের সঙ্গে জড়িত নই। এর বাইরে যা বলার, সিবিআই ডাকলে তাদের বলব। অন্য কোনও মন্তব্য করব না।” আর সুরজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আপনারা সবাই আমাকে চেনেন। নতুন করে বলার কিছু নেই। আমি আগেও বলেছি যে, ওটা ছিল একটা প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। এক সিনিয়র সহকর্মীর অনুরোধে আমি গিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy