শেখ আনসার আহমেদ।
ঘর তৈরির ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা এসেছিল তাঁর বাবার নামে। কিন্তু তা নিতে গেলে তিন হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়।
সে দিনই তরুণটি ঠিক করে ফেলেছিলেন, যদিও নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পারেন, হতে পারেন সরকারি আমলা, এই দুর্নীতি চলতে দেবেন না। নদিয়ার কৃষ্ণনগর ১-এ বিডিও হয়ে এসে সেই কাজটাই শুরু করেছেন দেশের কনিষ্ঠতম আইএএস অফিসার শেখ আনসার আহমেদ।
আপাতত তালিকা হাতে তিনি ঘুরছেন বাড়ি-বাড়ি। স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য রাজ্য সরকারের বাড়ি তৈরির ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকল্পের ভুয়ো উপভোক্তাদের খুঁজে বের করে কেটে দিচ্ছেন নাম। ব্লকের কয়েক জন অফিসারকে নিয়ে তৈরি করেছেন বিশেষ ‘গ্রুপ’। তালিকা হাতে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। হঠাৎ করে গিয়ে পড়ছেন উপভাক্তাদের বাড়িতে।
মঙ্গলবার যুগ্ম বিডিও-কে সঙ্গে নিয়ে ভাতজাংলা পঞ্চায়েত এলাকায় ন’জন উপভোক্তার বাড়িতে যান বিডিও। তার মধ্যে সাত জনেরই বাড়ি পাকা। নিয়ম অনুযায়ী, যাঁদের মাসিক আয় ছ’হাজার টাকার কম এবং পাকা বাড়ি নেই, কেবল তাঁরাই গীতাঞ্জলি প্রকল্পে টাকা পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। অথচ শুধু পোড়াগাছা গ্রাম পঞ্চায়েতে এখনও পর্যন্ত যে ৪৫ জনের বাড়িতে টিম গিয়েছে, তার ২১ জনেরই পাকা বাড়ি। ভাণ্ডারখোলায় সাতটির মধ্যে দু’টি, ভীমপুরে আটটি মধ্যে দু’টি পাকা। ভীমপুরের ওই দুই উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রথম কিস্তির ৪৯ হাজার টাকা জমাও পড়ে গিয়েছে। তাঁদের অবিলম্বে টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছেন বিডিও।
আরও পড়ুন: বঙ্গতনয়ার হাত ধরে ২৫ কোটির শৃঙ্গসরাস
মহারাষ্ট্রের খরাপ্রবণ জালনা জেলার শেরগাঁও গ্রামের দরিদ্র অটো চালকের ছেলে আনসার। অর্থাভাবে পড়া ছেড়ে মুদির দোকানে কাজ নিয়েছিল ভাই। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তিন দিদির। কখনও শুধু মিড-ডে মিলের খাবার খেয়ে, কখনও রাস্তার পাশে হোটেলে বাসন মেজে, ফটোকপির দোকানে খেটে ২০১৫ সালে আইএএস হয়েছেন আনসার। দারিদ্র্য কাকে বলে তা তিনি নিজের ঘর থেকে জেনেছেন আর জেনেছেন, অভাবে সকলের স্বভাব নষ্ট হয় না। বলছেন, ‘‘যাঁরা গীতাঞ্জলি প্রকল্পে ঘর পাওয়ার যোগ্য নন, তাঁদের নামের তালিকা করে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টাকা ফিরিয়ে না দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই, নড়াচড়া শুরু হয়ে গিয়েছে শাসক দলের অন্দরে। কৃষ্ণনগর ১ ব্লকের ভিতরে দুই মন্ত্রীর বিধানসভা এলাকা পড়ছে। কৃষ্ণনগর (দক্ষিণ) কেন্দ্রের বিধায়ক উজ্জ্বল বিশ্বাস রাজ্যের কারামন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি। কৃষ্ণনগর (উত্তর) কেন্দ্রের অবনীমোহন জোয়ারদারও দফতরহীন মন্ত্রী। গীতাঞ্জলির ঘরের জন্য মূলত বিধায়ক ও পঞ্চায়েত সমিতিরই জেলা প্রশাসনের কাছে নাম পাঠানোর কথা। আর কিছু নাম দেয় জেলা পরিষদ। কাজেই অনিয়ম হলে তাঁরা দায় এড়াতে পারেন না।
কারামন্ত্রী বলছেন, “আমি অনেক খতিয়ে দেখে নাম পাঠিয়েছি। এমন হওয়ার কথা নয়। আরও যারা নাম পাঠায়, তারা ভুল করল কি না দেখতে হবে।” অবনীমোহন আবার বলেন, “আমি কোনও নাম পাঠাইনি। বরং মু্খ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনিয়মের কথা জানিয়েছি।” কৃষ্ণনগর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, তৃণমূলের শিবনাথ ঘোষের দাবি, “কী ভাবে নামগুলো ঢুকল, বলতে পারব না। আমাদের তালিকায় এমন নাম ছিল না, যাদের পাকা বাড়ি আছে।” নদিয়ার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত বলেন, “দরকারে অন্য ব্লকগুলোকেও গীতাঞ্জলি প্রকল্পের তালিকা খতিয়ে দেখতে বলা হবে।”
আইএএস আনসার হয়তো বেশি দিন বিডিও পদে থাকবেন না। কিন্তু দুর্নীতির ঝুঁটিটা কী ভাবে চেপে ধরতে হয়, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy