Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঘুমের দাবিকে দুয়ো দিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণের মাসুল

ভাল করে ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে গাড়িটা। কিন্তু এ কী! স্টিয়ারিংয়ের উপরে মাথা রেখে চালক তো ঘুমিয়ে পড়েছেন! ‘কল টাইম’-এ পৌঁছতে হবে। বাড়ি থেকে চেন্নাই বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে ঝিমুনি ভাবটা কাটিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই ক্যাপ্টেন অরিন্দম দত্তের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল! নিজেকে সামলে চালকের পিঠে ধাক্কা মারতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্টিয়ারিং ডান দিকে ঘুরিয়ে দিলেন তিনি।

সায়নী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৪:১০
Share: Save:

ভাল করে ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে গাড়িটা। কিন্তু এ কী! স্টিয়ারিংয়ের উপরে মাথা রেখে চালক তো ঘুমিয়ে পড়েছেন!

‘কল টাইম’-এ পৌঁছতে হবে। বাড়ি থেকে চেন্নাই বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে ঝিমুনি ভাবটা কাটিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই ক্যাপ্টেন অরিন্দম দত্তের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল! নিজেকে সামলে চালকের পিঠে ধাক্কা মারতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্টিয়ারিং ডান দিকে ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। গাড়ি গিয়ে ধাক্কা মারল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের পিছনে। সে-যাত্রায় বেঁচে গেলেও হাতে চোট পান অরিন্দম।

অথবা এয়ার ইন্ডিয়ার সেই বিমানসেবিকা। কয়েক মাস আগের এক দুপুরে কলকাতায় বাড়ি ফেরার পথে যাঁর এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। টানা কয়েক ঘণ্টা উড়ানের ধকলে জড়িয়ে আসছিল চোখ। টালা ব্রিজ থেকে নামার সময় সামনের ম্যাটাডর ভ্যানের পিছনে ধাক্কা মেরে দিল আমার গাড়ির চালক! সে আহত হল। প্রচণ্ড চোট লাগল আমার হাতেও। জিজ্ঞাসা করলাম, কী করলে এটা? হাত কচলে চালক বলল, ম্যাডাম, চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। তাই...।’’

অরিন্দম বা ওই বিমানসেবিকার ঘটনা শুরু বা শেষ নয়। বরং প্রায় প্রতিদিনই কোনও ক্যাপ্টেন, বিমানসেবিকা বা বিমানকর্মী যাতায়াতের পথে এমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হচ্ছেন। অনেকে অবশ্য নিজেদের অভিজ্ঞতা বলার জন্য বেঁচে নেই। মুম্বইয়ের সৌমিক চট্টোপাধ্যায় যেমন। জেট ওয়ারওয়েজের এই পাইলট গত ৫ এপ্রিল ভোরে মুম্বই বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে তাঁর গাড়ি ধাক্কা মারে ডিভাইডারে। রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে ডাক্তারেরা জানিয়ে দেন, সব শেষ। গ্রেফতারের পরে পুলিশের কাছে চালক দাবি করেন, ঘাড়ের উপরে অন্য একটি গাড়ি এসে পড়ায় বাঁ দিকে চাপতে গিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারেন তিনি। পুলিশের ধারণা, অত ভোরে গাড়ি চালানোর সময় চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

ভুক্তভোগী শুধু বিমান সংস্থার পাইলট বা অন্য কর্মীরাই নন। সংবাদমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তির মতো যে-সব সংস্থায় কাজ চলে ২৪ ঘণ্টা, সেখানকার কর্মীদেরও এটা রোজকার অভিজ্ঞতা। যেমন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী শতদ্রু সামন্ত জানালেন, সম্প্রতি গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িচালকের তন্দ্রা কী ভাবে মৃত্যুর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎকার ঘটিয়ে দিতে যাচ্ছিল! তাঁর অফিসের গাড়িচালক ঘুমঘোরে কেমন করে গড়িয়াহাট সেতু থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলেন, তার বর্ণনা দিলেন ধর্মতলা এলাকার একটি সংবাদপত্রের কর্মী অনিন্দিতা পাল।

তথ্যপ্রযুক্তি হোক সংবাদমাধ্যম, বেশির ভাগ সংস্থাই নিজেদের কর্মীদের জন্য গাড়ি ভাড়া নেয়। পাইলট, বিমানসেবিকা ও কর্মীদের যাতায়াতের জন্য গাড়ি ভাড়া নিতে বিমান সংস্থাগুলিও বিভিন্ন গাড়ি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে। অভিযোগ, অধিকাংশ চালকই গাড়ি চালানোর সময় যথেষ্ট সজাগ থাকেন না। ওই সব গাড়িতে পরের পর দুর্ঘটনা যে ঘটেই চলেছে, সবই এই ধরনের আচ্ছন্নতা ও অসতর্কতার পরিণাম। বিমান সংস্থার কর্মীরা জানাচ্ছেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই সংশ্লিষ্ট গাড়িচালকের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের তদন্তের পরে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় চালকের বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না।

কেন?

উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন বিমান সংস্থার কর্মী-অফিসারেরা আঙুল তুলেছেন গাড়ি সংস্থার পরিকাঠামোর অভাবের দিকে। তাঁদের বক্তব্য, গোড়াতেই গলদ রয়েছে। কোনও গাড়িচালকের ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করার কথাই নয়। অথচ গাড়ি সংস্থাগুলি সেই নিয়মটা মানছে না। তার কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, চালকের অভাব। দ্বিতীয়ত, চালকদের বেশি টাকা উপার্জনের তাগিদ। গাড়ি সংস্থা প্রথম সমস্যাটা মেটাতে পারে বাড়তি চালকের ব্যবস্থা করে। কিন্তু একই চালককে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি কাজ করালে বাড়তি যেটুকু টাকা দিতে হয়, সেই জায়গায় একাধিক চালক রাখলে খরচ বেশি পড়ে। তাই যেখানে দুই বা ততোধিক চালক দরকার, সেখানে এক জন চালককে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত টাকার উপরে সামান্য কিছু দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। কিছু উপরির আশায় শরীরের দাবি উপেক্ষা করে চালকও সেই বাড়তি সময় গাড়ি চালাতে রাজি হয়ে যান। এতে গাড়ি সংস্থার সুবিধে হচ্ছে এবং আপাতদৃষ্টিতে হয়তো চালকেরও পকেটে কিছু আসছে। কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না চালকের শরীর। অনিয়মের মাসুল নিচ্ছে সে। শরীরের দাবি উপেক্ষা করে অনেক চালকই টানা ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করেন। নির্ধারিত সময়ে কর্মী-অফিসারদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার তাড়া থাকে তাঁদের। সব মিলিয়ে তাল সামলাতে না-পেরে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছেন তাঁরা। বিশ্রাম ও ঘুমের অভাবে অনেক সময়েই স্টিয়ারিংয়ের উপরে বশে থাকছে না হাত। বিমান সংস্থার কর্মী-অফিসারদের অভিজ্ঞতা, মূলত গভীর রাত ও ভোরের দিকেই চালকদের নিয়ে সমস্যা হয় বেশি। প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘুম তখন কাবু করে ফেলে গাড়িচালকদের।

কেন ঘুমিয়ে পড়ছেন চালকেরা?

চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে গেলে এক জন মানুষের কম করে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। সেটা না-হলে অথবা ঘুমের সময় ঘনঘন বদল হলে মানসিক ক্লান্তি বাড়ে। তাতে কাজে মন দেওয়া যায় না। গাড়ি চালাতে গিয়ে ঝিমুনি আসে। ‘‘ওই অবস্থায় গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়,’’ বলছেন সুকুমারবাবু।

আশঙ্কা যেখানে রয়েছে, সেখানে গাড়িচালকদের দিয়ে এ ভাবে অতিরিক্ত কাজ করানো হচ্ছে কেন?

১৫ বছর ধরে একাধিক বিমান সংস্থাকে গাড়ি পরিষেবা দিয়ে আসছে, এমন একটি সংস্থার তরফে শ্যামলী সরকার বলেন, ‘‘বেশির ভাগ চালক পড়শি রাজ্য থেকে আসেন রোজগার করতে। তাঁরা যাতে সুস্থ ভাবে কাজ করতে পারেন, সেটা দেখার কথা গাড়ি অপারেটরদেরই।’’ শ্যামলীদেবীর দাবি, তাঁর সংস্থায় নির্দিষ্ট সময় কাজ করানোর নিয়ম মানা হয়। তাঁদের গাড়িচালকেরা সর্বাধিক ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। সকলকেই বিশ্রামের জন্য ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। তাঁর মতে, ‘‘ডিউটি আর বিশ্রামের মধ্যে সমন্বয় না-থাকলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়।’’

তা হলে উপায় কী?

গাড়িচালকদের অনেকে বলছেন, বাড়তি সময় খাটতে বাধ্য না-হলে এমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একই চালককে দিয়ে টানা কাজ না-করিয়ে যথেষ্ট সংখ্যায় লোক নিয়োগ করলে নির্দিষ্ট সময়টুকু কাজ করলেই সকলে বিশ্রাম পায়, সমাধান শোনালেন পরাশর ঝা (ছদ্মনাম) নামে এক গাড়িচালক। কিন্তু বাড়তি রোজগারের আশায় চালকেরাই তো বিশ্রাম না-নিয়ে টানা গাড়ি চালাতে রাজি হয়ে যান! তার কী হবে? পরাশরের সাফ জবাব, ‘‘সব ড্রাইভার মোটেই তা চায় না। কাজ চায়। বিশ্রামও চায়।’’

এই অবস্থায় নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিমানকর্মীরা এখন নিজেরাই দাওয়াই বার করে ফেলেছেন। জেট এয়ারওয়েজের ক্যাপ্টেন সর্বেশ গুপ্ত বলছেন, ‘‘মাঝরাতে বা ভোরের দিকে গাড়িতে থাকলে এখন আমরা সজাগ থেকে চালকের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাই। চালককে গান চালিয়ে দিতে বলি। পিছনের আসনে সিট বেল্ট থাকলে তা বেঁধে নিই।’’

এটা কি নিছক টোটকা, নাকি সমস্যার যথার্থ সমাধান?

সর্বেশের কথায়, ‘‘এর বেশি আমরা আর কী করতে পারি!’’ সর্বেশের মতো ‘নিজেকে নিরাপদ রাখতে’ এখন চালককে জাগিয়ে রাখার পথে হাঁটতে শুরু করেছেন অনেকেই। সাংবাদিক অনিন্দিতা যেমন এখন অনেক হুঁশিয়ার। রাতের গাড়িতে উঠেই চালককে বলেন, ‘গান চালাও তো ভাই। আর এই নাও, খাও।’ বলেই টফি-চকোলেট বাড়িয়ে দেন চালকের দিকে। নিজেও খান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE