Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মাঠে-ঘাটে প্রাতঃকৃত্য রুখেছে ‘ভোরের বন্ধু’

ভোরের আলো ফুটলেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র অনিমেষ সরকার। কোনও দিন নিজে থেকে ঘুম না ভাঙলেও চিন্তার কিছু নেই। বাবা-মাকে বলাই থাকে, ঘুম না ভাঙলে ডেকে দিতে। চোখে-মুখে জল দিয়েই বেরিয়ে পড়ে অনিমেষ। গলায় লাল সুতোয় ঝোলানো কালো বাঁশি। প্রথমেই সে হাজির হয় তার নিজের স্কুলের চত্বরে। সেখানে তত ক্ষণে আসতে শুরু করেছে তার সঙ্গীরা। সকলেরই গলায় ঝোলানো বাঁশি।

বাঁশি মুখে ভোরের বন্ধুরা। ছবিটি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।

বাঁশি মুখে ভোরের বন্ধুরা। ছবিটি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
বাগদা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০১:৪০
Share: Save:

ভোরের আলো ফুটলেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র অনিমেষ সরকার। কোনও দিন নিজে থেকে ঘুম না ভাঙলেও চিন্তার কিছু নেই। বাবা-মাকে বলাই থাকে, ঘুম না ভাঙলে ডেকে দিতে।

চোখে-মুখে জল দিয়েই বেরিয়ে পড়ে অনিমেষ। গলায় লাল সুতোয় ঝোলানো কালো বাঁশি। প্রথমেই সে হাজির হয় তার নিজের স্কুলের চত্বরে। সেখানে তত ক্ষণে আসতে শুরু করেছে তার সঙ্গীরা। সকলেরই গলায় ঝোলানো বাঁশি।

অনিমেষ দলনেতা। তার দলের নাম ‘সুভাষচন্দ্র বসু বাহিনী’। আকাশ মল্লিক, অনিমেষ মল্লিকের মতো পাঁচ খুদে তার সহযোদ্ধা। কেউ তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, কেউ বা চতুর্থ শ্রেণির। সকলে এসে গেলে তারা বেরিয়ে পড়ে ‘তদন্তে’। গোটা গ্রামের মাঠঘাট, রাস্তা, বনজঙ্গল চষে ফেলে। খোলা জায়গায় কাউকে প্রাকৃতিক কাজ সারতে দেখলে সমস্বরে বাঁশি বাজিয়ে পাড়া-পড়শিকে জানিয়ে দেয়।

ছেলেদের দলের মতো মেয়েদের নিয়েও ব্লক প্রশাসনের তরফে তৈরি হয়েছে ‘রানি লক্ষ্মীবাই বাহিনী’। শ্রীমতী মল্লিক, পুষ্প বিশ্বাস, তিথি রায়ের মতো আট খুদে তার সদস্য। তারাও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বাঁশির আওয়াজ শুনলেই ধরা পড়ার ভয়ে পালান অনেকে। কিন্তু গ্রামের খুদেরা সকলেরই মুখ চেনে। ফলে পালালেও মান বাঁচে না। গ্রামে কমিটি গড়া হয়েছে। ধরা পড়লেই ৫০ টাকা করে জরিমানা। এই খুদেদের দাপটেই উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা ব্লকের কোনিয়ারা-২ পঞ্চায়েতের ঘাটপাতিলা বাগদিপাড়া গ্রামে খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য করা কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ মাস দুয়েক আগেও পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ অন্য রকম ছিল। গ্রামের বেশির ভাগ মহিলা-পুরুষ উন্মুক্ত জায়গাতেই প্রাত্যঃকৃত্য সারতে অভ্যস্ত ছিলেন।

বাগদার ওই গ্রামে প্রায় পৌনে দু’শো পরিবারের বাস। সেগুলির প্রায় সবই দারিদ্রসীমার নীচে। খেতমজুরি করে বা কোদালিয়া নদী ও সরিষাঘাটা বাঁওড়ে মাছ ধরে কোনও মতে দিন গুজরান করেন তাঁরা। এলাকায় কাজ না থাকায় অনেকেই ভিন্ রাজ্যে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে যান। খেতে কাজ করে দিনে ১২০-১৫০ টাকা মেলে। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময়েই কাজ থাকে না।

গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, দুপুর ১২টাতেও অনেক বাড়িতে উনুন জ্বলেনি। বাড়ি না বলে মাথা গোঁজার আস্তানা বলাই ভাল। ভাঙা টালি, টিন, বিচুলি, ত্রিপল দেওয়া ছাউনি। মাটি, পাটকাঠি বা টিনের দেওয়াল।

এই রকম একটি গ্রামে শৌচাগার সম্পর্কে সচেতনতা থাকবে, এমন কথা ভাবাটাই কার্যত অসম্ভব ছিল। বেশির ভাগ বাড়িতেই ছিল না শৌচাগার। এখন অবশ্য প্রতিটি বাড়িতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাকা শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

গ্রামের মধ্যেই পাকা দোতলা ঘাটপাতিলা শিশু শিক্ষা নিকেতন। পড়ুয়ার সংখ্যা ১১৮। স্কুল থেকে নীল জামা-প্যান্ট দেওয়া হয়েছে। তবে ওই পর্যন্তই। অনেকেই আর হাইস্কুলে যায় না। বেলা ১১টা বেজে গেলেও দেখা গেল, শিক্ষক-শিক্ষিকা আসেননি। পড়ুয়ারা স্কুল চত্বরে খেলা করছে। ওই স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়েই তৈরি হয়েছে বিশেষ বাহিনী।

কী ভাবে সম্ভব হল এই পরিবর্তন?

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর পুজোর আগে বিভিন্ন এলাকায় সরকারি শৌচাগার তৈরির কাজ দেখতে বেরিয়ে এই গ্রামে এসে হাজির হন বাগদার বিডিও মালবিকা খাটুয়া। এর পরেই প্রতিটি বাড়িতে সরকারি শৌচাগার গড়তে উদ্যোগী হয় ব্লক প্রশাসন। সরকারি প্রকল্পে শৌচাগার করতে হলে পরিবার প্রতি দিতে হয় ৯০০ টাকা। সরকার দেয় ১০৫০০ টাকা। ব্লক প্রশাসন ও বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে গ্রামবাসীকে শৌচাগারের উপকারিতা বোঝানো হয়। চালানো হয় প্রচার। ধীরে-ধীরে সব পরিবারই রাজি হয়ে যায়। তবে সকলের পক্ষে ৯০০ টাকা করে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

যাঁরা ৯০০ টাকা জোগাড় করতে পারেননি, এলাকার যুবকেরাই তাঁদের জন্য চাঁদা তোলেন। ওই যুবকদের এক জন বিপিন তরফদার বাড়িতে ছাত্রছাত্রী পড়ান। তাঁর কথায়, ‘‘মোহিনী বিশ্বাস, মুক্তি বিশ্বাস, শিবু বিশ্বাস, কালিদাসী সাঁতরার মতো অনেকেই শৌচাগারের জন্য টাকা দিতে পারেননি। আমরা তাঁদের জন্য চাঁদা তুলে দিয়েছি। তাঁরাও এখন শৌচাগার পেয়েছেন।’’

শৌচাগার গড়ার পরে দেওয়ালে নানা সচেতনতামূলক কথাও লিখে দেওয়া হয়েছে। যেমন— ‘মাঠেঘাটে পায়খানা মৃত্যুর পরোয়ানা’ বা ‘খোলা মাঠে মলত্যাগ করা মৃত্যুর কারণ’। প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘ঘাটপাতিলা জল ও স্বাস্থ্য বিধান কমিটি’ গড়া হয়েছে। তারা সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। তাতে লেখা— ‘‘আমি গর্বিত, আমার বাড়িতে একটি শৌচাগার রয়েছে।’’ বা ‘‘আমি গর্বিত, আমি খোলা আকাশের নীচে পায়খানা করি না।’’

তবে, এত কিছুর পরেও সকলের খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য করার অভ্যেস বন্ধ করা যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে বিডিও স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে দু’টি দল গড়ে দেন। অনিমেষ-শ্রীমতীরা বলে, ‘‘কেউ মাঠে বসলেও দূর থেকে আমাদের দেখলেই পালিয়ে যান। এই কাজটা আমাদের খুব ভাল লাগে। আমরা নিজেরাও শৌচাগার ব্যবহার করি।’’ বিপিনবাবু বলেন ‘‘যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁরা সকলের সামনে মাথা নিচু করে কথা দিয়েছেন যে আর খোলা জায়গায় মলত্যাগ করবেন না। সঙ্গে ৫০ টাকা জরিমানা। ওই টাকা কমিটির কাছে রাখা আছে। গ্রামের উন্নয়নের কাজে খরচ হবে।’’ গ্রামের সুমিত্রা বিশ্বাস জানান, ‘‘আগে মাঠে-জঙ্গলে গেলেই পায়ে নোংরা লেগে যেত। স্নান করতে হত। এখন অনেক নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারি। খুদেরাই বদল এনেছে।’’

গ্রামের অনেকেই জানান, টানা সচেতনতা প্রচারের জেরে চোলাই খেয়ে মাতলামো করা বা দিনে-দুপুরে জুয়া খেলাও অনেক কমে গিয়েছে। তবে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে। গ্রামে বিদ্যুতের লাইন থাকলেও বাড়িতে নেই। প্রথমে বাড়িতেও লাইন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় কেটে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাতে আলো ছিল, এখন নেই। অধিকাংশ রাস্তা মাটির। বেশির ভাগ পরিবারই পাকা ঘর পায়নি। বিডিও অবশ্য আশ্বাস দেন, ইটের রাস্তা হবে। গীতাঞ্জলি প্রকল্পে সরকারি ঘরও দেওয়া হবে। গ্রামের মহিলাদের নিয়ে ন্যাপকিন তৈরির কর্মশালা হবে।

শৌচাগার প্রকল্পের সাফল্যের কথা শুনে জেলাশাসক মনমীত নন্দা ইতিমধ্যে গ্রামে ঘুরে গিয়েছেন। জেলা প্রশাসন অন্য ব্লকেও এই নজির তুলে ধরছে। এর পরেও অবশ্য খুদেদের পাহারায় খামতি নেই। গোড়ায় অনেকেই তাদের ভয় পেত, অপছন্দ করত। কিন্তু এখন তা বদলে গিয়েছে কৃতজ্ঞতা এবং ভালবাসায়।

কাঁচা ঘুম ছেড়ে বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে পড়া দামালদের গোটা ঘাটপাতিলা ডাকছে ‘ভোরের বন্ধু’ নামে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE