Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
রাজ্যের চিঠি সিবিআইকে

জানাই ছিল সারদা, মানল মমতা-সরকার

চার বছরে অন্তত ১২ বার! কখনও প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে, কখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে, কখনও সিবিআইয়ের তরফে তাগাদা এসেছে। কিন্তু কোনও সাড়াই মেলেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের তরফে!

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

চার বছরে অন্তত ১২ বার!

কখনও প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে, কখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে, কখনও সিবিআইয়ের তরফে তাগাদা এসেছে। কিন্তু কোনও সাড়াই মেলেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের তরফে! অবশেষে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে রীতিমতো জবাবদিহি চেয়ে চিঠি দিয়েছিল সিবিআই। তা-ও জুনের গোড়ায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে অবশেষে সপ্তাহ দু’য়েক আগে নবান্নের তরফে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের সেই জবাবদিহি পৌঁছেছে সিবিআইয়ের কাছে! সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কখন, কী ব্যবস্থা নিয়েছে — রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর তৈরি করে দেওয়া জবাবি চিঠিতে মূলত সেটাই জানানো হয়েছে।

এবং সেই চিঠির সূত্রেই উঠে এসেছে বৈপরীত্যের ছবি।

কী রকম?

সিবিআই-কে পাঠানো রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের চিঠিতে বলা হয়েছে, সারদার বেআইনি কাজকর্ম নিয়ে রাজ্যের অর্থ দফতর ২০০৯ থেকেই অবগত রয়েছে। তবু এই নিয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয়নি। কারণ, এই ধরনের অভিযোগের তদন্ত করার অধিকার রাজ্য সরকারের নেই। নবান্নের চিঠিতে এমন দাবি করা হলেও ২০১৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যবাসীকে কিন্তু অন্য তথ্য দিয়েছিলেন। নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, সে বছর এপ্রিলে সারদার একটি টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জানান অর্পিতা ঘোষ (বর্তমানে তৃণমূল সাংসদ)। কর্মীদের পিএফ-এর টাকা জমা দেয়নি ওই সংস্থা— অভিযোগ ছিল এমনই। এর কয়েক দিন পর সেই প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, ওই অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেই তাঁরা ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির কাজকারবার সম্পর্কে জানতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেছিলেন, ‘‘সেবি আমাকে কিছু দিন আগে চিঠি দিয়ে একটি সংস্থার বিরুদ্ধে সতর্ক করে। তার পরেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগী হই।’’ অর্পিতা ঘোষের ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে কাশ্মীরের পহেলগাঁও থেকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

প্রত্যাশিত ভাবেই সরকারের দেওয়া জবাবি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘রাজ্যের এই রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীকেই মিথ্যেবাদী সাজিয়ে দিল! তিনি তো বলেছিলেন, সারদার টাকা তোলা প্রসঙ্গে তিনি ২০১৩ সালের ১ বৈশাখ জানতে পেরেছেন। অথচ তাঁর সরকারের রিপোর্টই অন্য কথা বলছে!’’ শমীকের কটাক্ষ, ‘‘দেখা যাচ্ছে, শুধু তৃণমূল নয়, বাম জমানাতেও এদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত হয়নি।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর দাবি, ‘‘সারদা নিয়ে অসত্য কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী সাংবিধানিক অপরাধ করেছেন। তদন্ত না করিয়ে সারদার মতো চিটফান্ডগুলিকে মদত দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট যে প্রভাবশালীদের ধরতে বলেছে, তিনিই তাঁদের অন্যতম।’’ প্রায় একই মত বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রেরও। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলার পরেও তারা তদন্ত করেনি বলে স্বীকার করে নিয়েছে সরকার। এটা সরকার-সারদা গোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগের নামান্তর! ফলে সিবিআইয়ের উচিত সরকারের মাথাকে ধরা।’’

সারদা নিয়ে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও কেন রাজ্যের জবাব দিতে চার বছর লাগল?

স্বরাষ্ট্র দফতরের ব্যাখ্যা, রাজ্যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কারবার দেখাশোনার দায়িত্ব অর্থ দফতরের। তাদের কাছেই এই সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা সিবিআইয়ের তোলা প্রশ্ন নিয়ে অর্থ দফতরের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। তারা কোনও উত্তর না দেওয়ায় দিল্লিকেও এত দিন কিছু জানানো যায়নি। স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে রিপোর্ট না-পাঠানোর কারণ হিসেবে অর্থ দফতরের যুক্তি, রাজ্যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে তথ্য দেওয়া হয়েছে। তাই নতুন করে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। যদিও নবান্নের এক কর্তা জানান, এই নিয়ে বার বার তাগাদা আসায় স্বরাষ্ট্র দফতরের হাতে অর্থ দফতর রিপোর্ট তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে।

সরকারি সূত্রের খবর, সারদা নিয়ে রাজ্যের কাছে মূলত দু’টি প্রশ্ন জানতে চেয়েছিল সিবিআই। প্রথমত, ২০১১-১২ সালে বাজার থেকে সারদা গোষ্ঠীর বেআইনি টাকা তোলা নিয়ে কেন্দ্রের কাছ থেকে রাজ্য সরকার কোনও অভিযোগ পেয়েছিল কি না। দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে তৎকালীন কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে সারদা নিয়ে যে অভিযোগ করেছিলেন, তার কোনও তদন্ত হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে তার রিপোর্ট এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানানো হোক।

এর জবাব দিতে গিয়ে ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজ্য অর্থ দফতরের ‘ইকনমিক অফেন্স ইনভেস্টিগেশন সেল’-এর ওসি-র তৈরি একটি আড়াই পাতার ‘নোটশিট’-কেই হাতিয়ার করা হয়েছে। ওই নোটশিট-এ জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের নামে বেশ কিছু সংস্থা গ্রামে গ্রামে কী ভাবে টাকা তুলছে, ২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সে সম্পর্কে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছিল রাজ্যকে। তাতে সারদা রিয়েলটির নামও ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক খোঁজখবর করে ২০১০ সালের ২৩ এপ্রিল রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (আরওসি)-এর অফিসে চিঠি পাঠিয়ে রাজ্য ব্যবস্থা নিতে বলে। সেবি-কেও ঘটনার কথা জানানো হয়। এর পর ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর সারদা-সহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাজার থেকে বেআইনি ভাবে টাকা তোলার ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তার পরে ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল সরাসরি আমানতকারীদের কাছ থেকে সারদা নিয়ে অভিযোগ পায় রাজ্য। প্রাথমিক তদন্তে তা সঠিক মনে হওয়ায় সেই অভিযোগও আরওসি-র কাছে পাঠানো হয়েছিল। অভিযোগগুলি পাঠানো হয়েছিল বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশনের কাছেও। চিঠিতে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, যে হেতু অর্থ দফতরের হাতে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনার কোনও আইন নেই, তাই সরকার নিজে কিছু করেনি। তবে যখনই এই সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে, তখনই তা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কংগ্রেস সাংসদের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্যের জবাবি চিঠিতে বলা হয়েছে, যে ধরনের অভিযোগ তিনি করেছিলেন, সেই ধরনের অনেক অভিযোগ সরকারের কাছে আগেই জমা পড়েছিল। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দফতরই জানিয়েছিল, এই ধরনের অভিযোগ কেন্দ্রীয় আর্থিক পরিষেবা বিষয়ক দফতরের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। ফলে এ নিয়ে রাজ্যের কী করা উচিত, তা স্পষ্ট নয়।

সিবিআইয়ের এক কর্তার দাবি, ‘‘সরকারের উত্তরেই প্রমাণিত, সারদার ব্যবসা বিস্তারে রাজ্যের পরোক্ষে একটা ভূমিকা ছিল। এবং সেই কারণেই সরকার কোনও তদন্ত করেনি। ব্যবস্থাও নেয়নি। বার বার চাপ দেওয়ার পরে এখন উত্তর দিতে বাধ্য হয়েছে।’’ তদন্তকারী সংস্থা সূত্রের খবর, সরকারের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ দফতরের অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কার প্রভাবে এ নিয়ে তদন্ত হয়নি এবং এ নিয়ে তাঁদের উপর কোনও প্রভাব কাজ করেছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE