আলুতে ডাহা ফেল, চালেও তা-ই। তা সত্ত্বেও এ বার খুচরো বাজারে মাছ বিক্রির পরিকল্পনা করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে যা নিয়ে গোড়াতেই সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।
খোলা বাজারে আলুর দাম বাঁধতে রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করেছিল গত এপ্রিল-মে মাসে। তখন জ্যোতি আলুর দর যাচ্ছিল ১৬ টাকা কেজি। গত ছ’মাসে সরকার ও ব্যবসায়ীদের টানাপড়েনের জেরে সেই দাম এখন ২২ টাকা। তার পরেও নবান্নে বৃহস্পতিবার সরকারি টাস্ক ফোর্সের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আলু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ‘প্রতারণার’ অভিযোগ তুলে ভিন রাজ্যে আলু পাঠানোয় ফের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যা শুনে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ারি, ডিসেম্বরে চাষিদের থেকে তাঁরা নতুন আলু কিনবেন না। পরের পরিস্থিতির দায় সরকারকেই বইতে হবে বলে তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের মধ্যেই প্রশ্ন, সরকারের দরকারটা কি বাজারে হস্তক্ষেপ করার?
বস্তুত সরকারি কর্তাদের একাংশর আক্ষেপ, এই সরকার বাস্তব থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। এরা ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরেই চালের বাজারে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, চালকল-মালিকেরা সরাসরি চাষিদের থেকে ধান কিনবেন সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যে, দাম মেটাবেন চেক মারফত। সরকারের ব্যাখ্যা ছিল, আড়তদার বা ফড়েদের হাতে যাতে বাজারের রাশ চলে না যায়, তা সুনিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা।
ঘটনা হল, নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে নাকানি-চোবানি খেতে হয়েছে। রাজ্যের অধিকাংশ চাষি ছোট জমিতে ধান ফলান। মিল-মালিকদের সঙ্গে দরদামে তাঁরা পেরে উঠছিলেন না। আবার আড়তদারেরা এসে বাড়ি থেকে ধান নিয়ে যাবেন, সেই সুবিধেও বন্ধ। সব মিলিয়ে প্রথম বছরেই বিস্তর সমস্যা। ২০১২, ২০১৩-য় দেখা গেল, ধানের বাজারে ফের আড়তদারদেরই রমরমা। ওই দু’বছর বাজারে দাম ভাল থাকায় বহু চাষি সরকারের পরিবর্তে আড়তদারকে বেশি দরে ধান বেচেছিলেন। বাধা দিতে গিয়ে চাষিদের প্রতিবাদের মুখে পড়ে সরকারও আর এগোয়নি। ধানে নাস্তানাবুদ হওয়ার পরেও আলু নিয়ে সরকার একই পথ ধরেছে। প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য: খোলা বাজারে দাম কমাতে রাজ্য সরকার ১৪ টাকা কেজি দরে আলু বেচতে শুরু করেছিল। উল্টে তাতে দাম বেড়েছে। শেষমেশ ভিন রাজ্যে আলু পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। রাজ্যের বিভিন্ন সীমানায় প্রশাসন আলুর লরি আটকায়। জল গড়ায় অনেক দূর। পশ্চিমবঙ্গের আলু না-পেয়ে পড়শি রাজ্যগুলো এখানে মাছ, পেঁয়াজ পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
বেগতিক দেখে নবান্ন পুজোর আগে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এ দিন তা ফের বলবৎ হয়েছে। নবান্নে টাস্ক ফোর্সের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি মতো রাজ্যকে দৈনিক দু’শো টন আলু দিচ্ছেন না। তাই তাঁদেরও অন্য রাজ্যে আলু পাঠাতে দেওয়া হবে না।
এই আকচা-আকচির মধ্যে আলুর দাম কমার কোনও লক্ষণ নেই। প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বরেন মণ্ডলের কথায়, “আলুর নিয়ন্ত্রণ সরকার হাতে নেওয়ায় বাজারের স্বাভাবিক অর্থনীতি মার খেয়েছে। তাই দাম কমেনি।” রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়ের দাবি, “আলুর দাম কোনও রাজ্যে ৪০ টাকা, কোথাও ৫০। পশ্চিমবঙ্গে এখন ২২। সরকার নিয়ন্ত্রণ না-করলে আরও বাড়ত।” মন্ত্রীর যুক্তি, “পাকিস্তানে আলুর চাহিদা বেশি থাকায় দেশের প্রচুর আলু ওখানে গিয়েছে। তাই দাম বেড়েছে।” কিন্তু খোলা বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা কি সরকারের কাজ?
কৃষি বিপণন দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, চাহিদা-জোগানের উপরে খোলা বাজারে পণ্যের দাম নির্ভরশীল। এখানে সরকারের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না। তা ছাড়া চাষির থেকে পণ্য কিনে তা বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বিভিন্ন স্তরে যে পরিকাঠামোর দরকার, সরকারের তা নেই। তবু ‘লোক দেখাতে’ গিয়ে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি জটিল করে ফেলা হচ্ছে ওঁদের অভিযোগ।
চাল ও আলুর ক্ষেত্রে তেমনটি হলেও সরকার কিন্তু থামতে নারাজ। এ দিন নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই পরিকল্পনা হয়েছে, রাজ্য এ বার খোলা বাজারে মাছও বেচবে। কেন?
টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য রবীন্দ্রনাথ কোলের ব্যাখ্যা: মাছের পাইকারি দামের সঙ্গে খুচরো দামে বিস্তর ফারাক থাকছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। তাই মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে মাছ বিক্রির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের দাবি, “পাইকারির সঙ্গে খুচরো বাজারে দামের ফারাক হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ! ব্যাপারটা বুঝতে আগামী মঙ্গলবার মাছ-ব্যবসায়ীদের বৈঠকে ডাকা হয়েছে।”
ফোর্সের এক সদস্য জানান, বৈঠকে মৎস্যমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, অন্ধ্রে যে ভাবে মাছ চাষ হচ্ছে, সেই ভাবে এ রাজ্যেও মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy