স্রেফ একটা শব্দ! তা নিয়েই গোল বেঁধেছে বিস্তর।
উপকূলীয় বিধি অনুযায়ী, দেশের যে কোনও সংরক্ষিত জীবমণ্ডল (বায়োস্ফিয়ার) সিআরজেড-১ তকমা পেয়েছে। মানে, পরিবেশগত ভাবে সর্বাধিক সংবেদনশীল অঞ্চল। তাই সেখানে যত্রতত্র নির্মাণ (বাড়ি-ঘর, রাস্তা, হোটেল, বাজার ইত্যাদি) নিষেধ। এ দিকে জনবসতি-সহ তামাম সুন্দরবনকে ফেলা হয়েছে বায়োস্ফিয়ারের আওতায়, যার সুবাদে সুন্দরবনের পুরোটাই এখন সিআরজেড-১। ফলে ওই তল্লাটে যে কোনও নির্মাণকাজ আইনি ফাঁসে আটকে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। এতে উন্নয়ন ব্যাহত হবে কিনা, সেই প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠেছে।
আর পুরো বিতর্কের মূলে রয়েছে একটাই শব্দ— বায়োস্ফিয়ার। উপকূল-বিধি থেকে যা ছেঁটে ফেলতে নয়াদিল্লিকে প্রস্তাব দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
রাজ্য বন ও পরিবেশ দফতরের নথি অনুযায়ী, সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ারের মধ্যে পড়ছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ জনবসতি অঞ্চল— হাড়োয়া, সন্দেশখালি, থেকে শুরু করে ক্যানিং, মথুরাপুর, জয়নগর, কাকদ্বীপ ইত্যাদি। তট-বিধি মানতে গেলে সেখানে যত্রতত্র নির্মাণ করা যাবে না। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা অনেক সরকারি বাড়িও ভাঙা পড়বে। প্রশাসনের খবর, এই কারণ দেখিয়ে রাজ্যের পরিবেশ-সচিব সম্প্রতি বন ও পরিবেশ মন্ত্রকে চিঠি লিখে প্রস্তাব দিয়েছেন, উপকূলীয় বিধি থেকেই ‘বায়োস্ফিয়ার’ শব্দটি বাদ দেওয়া হোক। এতে সুন্দরবনের জনবসতিপূর্ণ ১৮টি ব্লকে উন্নয়নের কাজ সহজ হবে বলে কর্তারা মনে করছেন।
ঘটনা হল, সুন্দরবনের বায়োস্ফিয়ারকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ১৯৯১-এ। উপকূল-বিধি তৈরি হয় ২০১১-য়। তখনই রাজ্য সরকার আপত্তি তোলেনি কেন?
পরিবেশ-সূত্রের দাবি, তুলেছিল। তবে লাভ হয়নি। এক প্রাক্তন পরিবেশ-কর্তা জানান, সুন্দরবনই দেশের একমাত্র সংরক্ষিত এলাকা, যার মধ্যে এতগুলো জনবসতি রয়েছে। ‘‘এই যুক্তিতে আমরা আপত্তি করলেও তখন কেন্দ্র আমল দেয়নি। ২০১১-য় রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।’’— বলছেন তিনি।
তা হলে এত দিন বাদে দিল্লিকে আবার চিঠি কেন?
দফতরের একাংশের ব্যাখ্যা: ভবিষ্যতে আরও জটিলতার সম্ভাবনা এড়াতেই ফের তৎপরতা। এই মহলের বক্তব্য: সুন্দরবনের দূষণ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করেছে। অবৈধ হোটেল বন্ধ এবং বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে আদালত নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসনকে। ‘‘যাঁদের হোটেল বন্ধের নির্দেশ, তাঁরা এ বার পুরো বায়োস্ফিয়ারের আওতাভুক্ত যাবতীয় নির্মাণ ভাঙার আর্জি নিয়ে কোর্টে হাজির হলে কী হবে?’’— শঙ্কিত প্রশ্ন এক আধিকারিকের। ওঁদের আশঙ্কা, সে ক্ষেত্রে বহু ব্লকে খাস বিডিও অফিস-সহ সরকারি অনেক বাড়ি ভেঙে ফেলতে হবে। বড় ধরনের গোলমাল দেখা দেবে। ‘‘মানুষের কথা মাথায় রেখে যুক্তিসঙ্গত ভাবেই আমরা উপকূল-বিধিতে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছি।’’— দাবি করছেন রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার।
রাজ্যের প্রয়াসের নেপথ্যে অন্য অঙ্কও দেখছেন কেউ কেউ। এঁদের মতে, পরিবেশ আদালত পাছে সুন্দরবন লাগোয়া বিস্তীর্ণ জনবসতি এলাকায় নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ জারি করে, তাই বিধানসভা নির্বাচনের মুখে এ হেন তৎপরতা। এমন ফরমান এলে বহু পরিবার আর্থিক দুর্দশায় পড়বে, যার প্রভাব পড়তে পারে শাসকদলের ভোটব্যাঙ্কে। রাজ্যের প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সুন্দরবনে আয়ের পথ খুব বেশি নেই। বিধির কড়াকড়ি হলে রুটি-রুজিতে টান পড়বে। কিন্তু গত চার বছরে এ নিয়ে নাড়াচাড়া হয়নি। ভোটের আগে চমক দিতেই এখন এ সব হচ্ছে।’’
প্রসঙ্গত, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও সম্প্রতি সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি হোটেল বন্ধ করতে বলেছে। অথচ পাখিরালয়-দয়াপুর-সাতজেলিয়া-বালিদ্বীপে রাজ্য সরকারের একটি অতিথিশালা-সহ সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আরও ৩৯টি হোটেল-অতিথিশালা রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো চলতে পারলে অন্যগুলো কী দোষ করল?
পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের জবাব, ‘‘আদালত থেকে হোটেলের যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা হয়েছে। আদালত নতুন তালিকা দিলে সেই মতো ব্যবস্থা হবে।’’
পরিবেশ দফতরের একাংশ অবশ্য মনে করে, তট-বিধি ঠিকঠাক মেনেও উন্নয়ন করা যায়। উপকূল পরিচালন পর্ষদের মাধ্যমে সেটা সম্ভব। কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রকের খবর, পশ্চিমবঙ্গে পর্ষদের কাজ কার্যত হয়ই না। উপকূল পরিচালনার সিংহভাগ টাকা যারা জোগায়, সেই বিশ্বব্যাঙ্কের একাধিক রিপোর্টে একই আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy