Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

২৫শে কী হবে, ভেবে অস্থির রাজ্য পুলিশ

শনিবারে কলকাতার পুরভোট আদর্শ পরিবেশে হয়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিজেই। ২৪ ঘণ্টা পরে তিনি তাঁর বলা কথা অনেকটাই গিলে নিয়েছেন বটে। কিন্তু আগামী শনিবারের দিকে তাকিয়ে রক্তচাপ আরও বেড়েছে জেলার পুলিশকর্তাদের।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

শনিবারে কলকাতার পুরভোট আদর্শ পরিবেশে হয়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিজেই। ২৪ ঘণ্টা পরে তিনি তাঁর বলা কথা অনেকটাই গিলে নিয়েছেন বটে। কিন্তু আগামী শনিবারের দিকে তাকিয়ে রক্তচাপ আরও বেড়েছে জেলার পুলিশকর্তাদের।

আগামী ২৫ এপ্রিল জেলায় জেলায় মোট ৯১টি পুরসভার ভোট রয়েছে। তার আগে ১৮ তারিখেই কলকাতা পুরভোটে পুলিশের সার্বিক অসহায়তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। শাসক দলের দুষ্কৃতীদের দাপাদাপির সামনে পুলিশ কিছু করতে তো পারেইনি, বরং গিরিশ পার্কে সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। খাস কলকাতার মতো জায়গায় যখন এই অবস্থা, তখন জেলায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল পরিকাঠামো নিয়ে পুলিশ কতটা কী করতে পারবে, সেটা ভেবে এখন থেকেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পুলিশ-কর্তারা।

রাজ্য পুলিশের এক কর্তা রবিবার বলেন, ‘‘শনিবার কলকাতার পুলিশ কমিশনারের ভূমিকা দেখা গেল। কাজ করতে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে গুলিবিদ্ধ হতেও দেখলেন সবাই। এর পর নির্বাচন কমিশনারের ঢোক গেলাও দেখা গেল! এর পরে কোন সাহসে আর কার ভরসায় পুলিশ বাহিনী ভোটের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করার কথা ভাববেন!’’ রাজ্য পুলিশের আর এক অফিসার বললেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ পরিকাঠামো, লোকবল সব দিকেই অনেক এগিয়ে। তুলনায় রাজ্য পুলিশের ক্ষমতা অনেকটাই কম। কলকাতা পুলিশই পুরভোটে যে আদর্শ পরিবেশ তৈরি করতে পারল না, রাজ্য পুলিশ সেটা করে ফেলবে— এমনটা ভাবলে ঘোড়াতেও হাসবে!’’

সুতরাং রাজ্য পুলিশ ইতিমধ্যেই ধরে নিয়েছে, শাসক দলকে আড়াল করেই তাদের চলতে হবে। বেশ কিছু জায়গায় তাঁদের উপরে সে রকম নির্দেশও এসে গিয়েছে। যেমন শনিবার কলকাতা পুরভোটের পরেই ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তা বলেছিলেন, ‘‘লাটবাগানে এক বৈঠকে আমাদের মৌখিক ভাবে জানানো হয়েছে, শাসক দলের অন্যায়-ত্রুটি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।’’

উত্তর ২৪ পরগণার এই শিল্পাঞ্চলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে এমনিতেই চিন্তায় রয়েছে শাসক দল। দমদম, বরাহনগর থেকে কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত ১৪টি পুরসভার ৪১৬টি ওয়ার্ডে গোঁজ প্রার্থী রয়েছেন ২০৫ জন। এর একটি বড় অংশই তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ। গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো এখানে মুকুল-অনুগামীরাও যথেষ্ট শক্তিশালী। সুতরাং পুলিশ যাতে ‘সঠিক’ ভূমিকা পালন করে, তার জন্য আগে থেকেই তাদের উপযুক্ত নির্দেশ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পাশাপাশি টিটাগড় এবং জগদ্দল এলাকায় বিজেপির প্রভাবও যথেষ্ট। সেখানকার এক পুলিশ কর্তা বলেছেন, ‘‘এই জায়গার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। এই বাহিনীকে পরিচালনা করব আমরা। তাই এ ক্ষেত্রেও কী করতে হবে, তা জলের মতোই পরিষ্কার।’’

পুলিশি ব্যবস্থা কোথায় কী রকম থাকবে, অভিযোগ, তার পিছনেও কাজ করছে অঙ্ক। যেমন? অভিযোগ, যে সব এলাকায় তৃণমূলের শক্তি নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে, সেখানেই পুলিশি ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বিশেষ করে প্রকট হয়ে পড়ছে। এর বড় উদাহরণ বসিরহাট। এখান থেকেই বিধানসভায় এসেছেন রাজ্যের একমাত্র বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য। বসিরহাট বিধানসভার উপনির্বাচনে দেখা গিয়েছিল, পঞ্চায়েত এলাকায় নিজেদের শক্তি মোটামুটি ধরে রাখতে পারলেও পুর এলাকায় ভরাডুবি হয়েছিল তৃণমূলের। এ বার চাকা ঘোরাতে মরিয়া তৃণমূল। তার জন্য দরকার পুলিশি সাহায্য। তাই বসিরহাটের বুথগুলি কার্যত অরক্ষিত রেখে সেই কাজের সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশের একাংশই জানিয়েছেন।

বসিরহাটের পুরভোটে ২৩টি ওয়ার্ডের ১১৫টি বুথ পাহারা দেওয়ার জন্য জেলার অন্যত্র থেকে ২০০ পুলিশকর্মী আনা হচ্ছে। এঁদের সঙ্গে থাকছেন বসিরহাট থানার আরও ৫০ জন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘সব বুথে যদি অন্তত দু’জন করেও পুলিশ মোতায়েন করতে হয়, তা হলে রাস্তায় পুলিশ রাখা যাবে না বললেই চলে। সেটা তো সম্ভব নয়!’’ এর পরেই তাঁর খেদোক্তি, ‘‘দু’জন পুলিশ কী করে একটি বুথ সামলাবে, তা-ও মাথায় ঢুকছে না!’’

আগামী শনিবারে বসিরহাট পুরসভার এই চিত্র কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিরোধীদের অভিযোগ, এ বার একই ঘটনা ঘটতে চলেছে অন্য জেলাতেও। শনিবারের ভোটে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও কলকাতা পুলিশের ভূমিকা দেখার পরে আগামী ভোটে রাজ্য পুলিশের উপরে বিশেষ ভরসাও রাখছেন না বিরোধী নেতারা। রবিবার বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘কলকাতা পুরভোট হাঁড়ির একটা ভাত। সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বাকি ৯১টি পুরসভায় ভোট কেমন হবে!’’

অনেকটা একই বক্তব্য পুলিশেরও। মালদহের এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘শাসক দলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ এলে এক রকম ব্যবস্থা, আর বিরোধীদের জন্য অন্য রকম। এ রকম করেই আমাদের চলতে হচ্ছে। পুরভোটের দিনেও তার অন্যথা হবে না।’’ বাঁকুড়ার এক পুলিশকর্তা বলেছেন, ‘‘সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে গত লোকসভা ভোটে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগের পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর পরে আর পুরভোটের নিরাপত্তা নিয়ে কী-ই বা বলার থাকতে পারে!’’

পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য মিলবে না ধরে নিয়ে মানুষের নিজস্ব প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাই বলছেন বিরোধীরা। পুরুলিয়া শহরে এক সভায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বলেন, ‘‘কলকাতায় মানুষ দেখেছেন, কী রকম ভোট হয়েছে। এই সন্ত্রাস বন্ধ করতে লাঠি, ঝাঁটা যা পারেন নিয়ে বেরিয়ে আসুন।’’

বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও বলেন, ‘‘শনিবার তৃণমূল যা করেছে, সেটা আসলে ২৫ তারিখ বাকি ৯১টি পুরসভার ভোটারদের সন্ত্রস্ত করার কৌশল। কলকাতার পুরভোট থেকে আমরাও শিক্ষা নিচ্ছি। সে ভাবেই নিজেদের তৈরি করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE