শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার নিয়ে ‘গেল গেল’ রব উঠছে বেশ কিছু দিন ধরে। তার মধ্যেই কাজ আদায়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এ বার জন পরিষেবা আইনে আরও বেশি দায়বদ্ধ করে তুলতে চাইছে রাজ্য সরকার।
কবে কোন পরীক্ষা হবে, অ্যাডমিট কার্ড কবে পাওয়া যাবে, পরীক্ষা শেষের কত দিনের মধ্যে পরীক্ষার্থীরা হাতে মার্কশিট পাবেন— এ বার থেকে শিক্ষা মরসুমের শুরুতেই তা জানিয়ে দিতে হবে। শুধু ছাত্রছাত্রীকে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তরফে তা জানাতে হবে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরকেও। সেই সূচি বা সময়সীমা না-মানলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে ওই দফতর। এবং সেই শাস্তিটা হতে পারে কারণ দর্শানোর নোটিস থেকে জরিমানা। এমনকী কোপ পড়তে পারে বেতনেও।
উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, শিক্ষাও সেবা। বলা যায়, সর্বোত্তম সেবা। স্বাস্থ্যের মতোই শিক্ষা সব নাগরিকের নিশ্চিত অধিকার। তাই ‘পশ্চিমবঙ্গ জন পরিষেবা অধিকার আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী সব বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়বদ্ধ করার উদ্যোগ চলছে। বিভিন্ন সরকারি দফতর, সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্থাগুলি নানান পরিষেবা দেয়। সেই সব পরিষেবা কত দিনের মধ্যে নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে আগাম জানাতে হয়। শুধু তা-ই নয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই পরিষেবা না-পেলে অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্মী-অফিসারকে শনাক্ত করে তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় ওই আইনে।
নির্দিষ্ট দায়িত্ব পাওয়া সরকারি দফতরগুলি সময় মেনে সাধারণ মানুষের কাছে বিভিন্ন পরিষেবা পৌঁছে দিতে দায়বদ্ধ। একই ভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে দায়বদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সময়সীমা মেনে চলাটা অনেক বেশি জরুরি। কারণ, যথাসময়ে পাঠ্যক্রম শেষ করা, পরীক্ষা নেওয়া এবং ফল ঘোষণার উপরে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই জন পরিষেবা অধিকার আইন অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীরা যে-সব পরিষেবা পেতে পারেন, সময় মেনে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে তার যাবতীয় বিবরণ পেশ দিতে বলা হয়েছে উচ্চশিক্ষা দফতরের কাছে।
ওই সব পরিষেবার মধ্যে আছে: কত দিনের মধ্যে পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড পাবেন পড়ুয়ারা, কত দিনের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার কথা, মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট বা ডুপ্লিকেট পরিচয়পত্র কত দিনের মধ্যে পড়ুয়ার কাছে পৌঁছে দিতে হবে ইত্যাদিও। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা যদি ঠিক সময়ে ফল প্রকাশ করতে না-পারেন বা অ্যাডমিট কার্ড দিতে না-পারেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে। রেজিস্ট্রারও যদি নির্দিষ্ট সময়ে বিষয়টি মেটাতে ব্যর্থ হন, তখন অভিযোগ যাবে উপাচার্যের কাছে। এবং উপাচার্য নিজে বিষয়টি পেশ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে বা কর্মসমিতিতে।
উচ্চশিক্ষা দফতর জানাচ্ছে, কর্মসমিতিতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শাস্তি হিসেবে প্রথমেই থাকবে গাফিলতির কারণ দর্শানো। তার পরে জরিমানা। শেষ পর্যন্ত মাইনেতেও কোপ পড়তে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার নিয়ে যাঁরা সরব, সরকারের এই উদ্যোগে ফের সেই স্বাধিকারেই হস্তক্ষেপ দেখছেন তাঁদের একাংশ।
আবার শিক্ষা শিবিরের অন্য অংশ বলছেন, স্বাধিকার মানে তো দায়িত্বে অবহেলা হতে পারে না। দায়িত্বের প্রতি আরও দায়বদ্ধ করে তোলাই যদি লক্ষ্য হয়, মূল উদ্দেশ্য যদি হয় পড়ুয়াদের স্বার্থরক্ষা, তা হলে জন পরিষেবা আইনে এই ব্যবস্থা স্বাগতম।
আর উচ্চশিক্ষা দফতরের শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য, স্বাধিকার-বিধি এবং জন পরিষেবা আইনের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। স্বাধিকার থাকবে স্বাধিকারের জায়গায়। সময়সীমা মেনে কাজ শেষ করা তো সকলেরই দায়িত্ব। ওই দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা চালু হচ্ছে যে-লক্ষ্যে, একই কারণে শিক্ষায় জন পরিষেবা আইন বলবত্ করতে চাইছে সরকার। ‘‘পড়ুয়ারা যাতে তাঁদের অধিকার থেকে, প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না-হন, ক্ষতিগ্রস্ত না-হন, সেটা নিশ্চিত করবে এই ব্যবস্থা। একই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার যাতে বজায় থাকে, সেটাও নিশ্চিত করা হবে,’’ আশ্বাস ওই শিক্ষাকর্তার।
এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা সরকারি আইন। সময়মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পরিষেবা দিতেই হবে। ঠিক সময়ে পরীক্ষা নেওয়া, ঠিক সময়ে পড়ুয়াদের হাতে মার্কশিট পৌঁছে দেওয়া— এগুলো নিশ্চিত করতে হবে। নইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তিনি জানান, এই সংক্রান্ত বিল বিধানসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে আগেই। উচ্চশিক্ষা দফতর তা জানিয়ে দিয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এই তথ্য হবে আলাদা। ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে তা নিজেদের মতো করে জমা দিতে বলা হয়েছে,’’ বললেন পার্থবাবু।
বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই ওই সব তথ্য পেশের কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে জানাচ্ছে উচ্চশিক্ষা দফতর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতরের নির্দেশিকা পেয়েই আমরা সমস্ত তথ্য তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।’’ বেশ কিছু তথ্য জমা দিয়েছে প্রেসিডেন্সি, রবীন্দ্রভারতী, বর্ধমান, বিদ্যাসাগর এবং বারাসতের পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও।
জন পরিষেবা আইন
পরিষেবা সুনিশ্চিত করার এই আইন রাজ্যের সব দফতর, সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সব সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওই সব সংস্থা থেকে নাগরিকদের যে-সব পরিষেবা পাওয়ার কথা, কবে তা মিলবে, সেটা আগাম জানাতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে পরিষেবা না-পেলে আধিকারিকের কাছে অভিযোগ করা যাবে। আধিকারিক ব্যবস্থা না-নিলে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানানো যেতে পারে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে। হতে পারে জরিমানা। এমনকী কোপ পড়তে পারে বেতনেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy