শ্রোতার আসনে (বাঁ দিক থেকে) শোভন চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়, যোগেন চৌধুরী ও শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। শনিবার নেতাজি ইন্ডোরে। — নিজস্ব চিত্র।
একাই দু’শো পারের দেমাক তোলা থাক বিরোধীদের দুরমুশ করতে। দলের অন্দরে ঝগড়া, রেষারেষি, সামন্তপ্রভুর মতো আচরণ, কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যে তিনি আর বরদাস্ত করবেন না, তা এ বার স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিধানসভা ভোটে ঐতিহাসিক সাফল্যের পর শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের প্রথম কর্মশালা করেন মমতা। বিপুল জনমত পাওয়ার দায় কত, বুঝতে অসুবিধা নেই তৃণমূলনেত্রীর। তিনি জানেন, এর ফলে দলের নেতাদের একাংশের মধ্যে অহঙ্কার, পারস্পরিক কোন্দল বাড়তে পারে। এমনিতেই বিধানসভা ভোটে একাধিক জায়গায় গোষ্ঠী কোন্দল ধরা পড়েছে। অন্তর্ঘাতের চেষ্টাও কম হয়নি। অথচ দু’বছর পরেই পঞ্চায়েত ভোট। ২০১৯-এ লোকসভা ভোট। সে সবের দিকে তাকিয়ে হাজার বিশেক নেতা-কর্মীর সামনে কড়া শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে দলকে শোধরানোর দাওয়াই দিলেন মমতা।
কী দাওয়াই দিলেন তিনি?
এক, মমতা এ দিন বুঝিয়ে দেন দলের রাজ্য ও জেলাস্তরে সমান্তরাল ক্ষমতার কেন্দ্র বলে আর কিছু থাকবে না। যাঁরা ভাল কাজ করেছেন, তাঁদের রাখা হবে। যাঁরা ভাল কাজ করেননি, তাঁদের ওপর নজর রাখা হবে। সঙ্গে এও বলেন, ‘‘গল্প সাজিয়ে কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া চলবে না। সেই সিদ্ধান্ত নেবে ‘রাজ্য’ (পড়ুন শীর্ষ নেতৃত্ব)।’’ রাজ্য স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি কমিটি গড়া হবে যাতে মমতা নিজেও থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন মুকুল রায়, সুব্রত বক্সি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীর মতো শীর্ষ নেতারা। প্রতি মাসের প্রথম শনিবার তাঁরা বৈঠক করবেন। জেলাস্তরেও এ ধরনের একটি কমিটি থাকবে। তারা মাসের শেষ শনিবার বৈঠক করবে।
দুই, গোষ্ঠী কোন্দল কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। যে নেতাদের ঝগড়ায় দলের ক্ষতি হয়েছে, কর্মীদের সামনেই তাঁদের কয়েক জনের নাম খোলা মঞ্চ থেকে জানান মমতা। এ প্রসঙ্গে কাকলি-সব্যসাচী-পুর্ণেন্দু-সুজিত বসুর নাম যেমন করেছেন, তেমনই দক্ষিণ দিনাজপুরে বিপ্লব মিত্র-সত্যেনদের কথাও বলেন।
তিন, মমতার নির্দেশ, দলের নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের এলাকার মানুষ ও কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। প্রত্যেক বিধায়ককে মাসে অন্তত একবার ব্লকের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘মাসে একবার আলোচনায় বসতে কীসের অসুবিধা?’’
চার, পুরসভাগুলিকে আরও ভাল কাজ করতে হবে। মমতার বক্তব্য, এ বার অনেক পুরসভায় ভোটের ফল ভাল হয়নি।
পাঁচ, দলের নেতাদের সামন্তপ্রভুর মতো আচরণ যে তিনি বরদাস্ত করবেন না, তা বোঝাতে গিয়ে নাম না করেও মালদহের ইংরেজবাজার বিধানসভার প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর দিকে আঙুল তোলেন মমতা। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘দলের কিছু নেতার অহঙ্কারের জন্যও বেশ কয়েকটি আসন এ বার হারাতে হয়েছে।’’
ছয়, কোনও জায়গাতেই তৃণমূলের একের বেশি শ্রমিক সংগঠন থাকবে না। মমতার কথায়, ‘‘একই জায়গায় দু-তিনটে করে ইউনিয়ন চালিয়ে কাউকে পকেটে টাকা পুরতে দেব না!’’ এই প্রসঙ্গে সাংসদ তথা আইএনটিটিইউসি নেত্রী দোলা সেনকে সতর্ক করে মমতা বলেন, ‘‘আমি যদি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারি, দোলা, তোমাকেও সবাইকে নিয়ে চলতে হবে।
সাত, দলের যুব সংগঠনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। মমতার কথায়, ‘‘জেলায় যুব সভাপতি হয়ে গাড়ি করে শুধু টো-টো করে ঘুরেলে চলবে না।’’
দলের জেলা কমিটিগুলি ভেঙে দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন মমতা। সেই সঙ্গে ইঙ্গিত দেন, ২১ জুলাই, শহিদ দিবসের পরে রাজ্য ও জেলাস্তরে বড় ধরনের সাংগঠনিক রদবদল করতে চান তিনি।
বস্তুত এ দিন মমতা যত বার নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের সতর্ক করেছেন, হাততালিতে ফেটে পড়েছেন গ্যালারিতে বসে থাকা নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা। অনেকেই পরে জানিয়েছেন, কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন দলের বহু নেতাই।
অনেকে আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতেই ব্যস্ত! এর পরেও কি দলের নেতারা দিদির কথা শুনে চলবেন? দেখা যাক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy