Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অস্ত্র-হাতে তাণ্ডব কলেজে, শিক্ষকের মাথায় পিস্তল, সত্তরের দশক ফিরল কি

তিনি ভোটে দাঁড়ালে ঘেঁটে যেতে পারে অঙ্ক। তাই কলেজের স্টাফরুমে ঢুকে অঙ্কের শিক্ষকের মাথায় পিস্তল ধরল কিছু যুবক। এ রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির নামে অসভ্যতা, এমনকী শিক্ষক নিগ্রহও অপরিচিত নয়। দিনরাত টানা ঘেরাও করে রেখে অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকদের হেনস্থা, মারধর তো বটেই।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে অধ্যক্ষকে শাসাচ্ছেন মনোজ (চিহ্নিত)।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে অধ্যক্ষকে শাসাচ্ছেন মনোজ (চিহ্নিত)।

সুস্মিত হালদার
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৬
Share: Save:

তিনি ভোটে দাঁড়ালে ঘেঁটে যেতে পারে অঙ্ক। তাই কলেজের স্টাফরুমে ঢুকে অঙ্কের শিক্ষকের মাথায় পিস্তল ধরল কিছু যুবক।

এ রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির নামে অসভ্যতা, এমনকী শিক্ষক নিগ্রহও অপরিচিত নয়। দিনরাত টানা ঘেরাও করে রেখে অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকদের হেনস্থা, মারধর তো বটেই। কামাই করায় কেশপুরে শিক্ষিকার জবাবদিহি চেয়ে হাত ধরে টানাটানি, মোবাইল ছুড়ে ফেলে দেওয়া তো এই গত বুধবারের ঘটনা।

কিন্তু সোমবার নদিয়ার শান্তিপুর কলেজে যা ঘটল— তার নজির ইদানীং কালে নেই। ঘটনাটা বরং উস্কে দিয়েছে নকশাল আমলের স্মৃতি।

শান্তিপুরে অভিযোগের তির শাসক দল ও তার অনুগামী ছাত্র সংগঠনের দিকেই। যদিও কলেজের অধ্যক্ষ চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য পুলিশের কাছে করা অভিযোগে কারও নাম দেননি। শুধু অবৈধ ভাবে কলেজে ঢুকে ‘গানপয়েন্ট’-এ হুমকি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, ঘটনাটি পুরনো। (যদিও সঙ্গের সিসিটিভি ফুটেজে দিনক্ষণ দেখা যাচ্ছে) তাঁর দাবি, ‘‘দিন কয়েক আগেই ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ আমায় বিষয়টি জানিয়েছিলেন। ওঁদের বলি, পুলিশে অভিযোগ করতে। কিন্তু তৃণমূলের কেউ জড়িত নয়।’’ এ দিন কিছু ঘটেছে বলেও তাঁর জানা নেই।


পাশে কলেজের তরফে শান্তিপুর থানায় করা অভিযোগের প্রতিলিপি।

কাল, ৩১ অগস্ট শান্তিপুর কলেজে পরিচালন সমিতির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন। যাতে শাসক দলের অপছন্দের শিক্ষকেরা কেউ না দাঁড়ান, তার জন্য হুমকি চলছিল বলে অভিযোগ। কয়েক দিন আগেই নবেন্দু বসাক নামে এক শিক্ষককে রাস্তায় মারধর করা হয়।

সোমবার দুপুর ১২টা ৫০ নাগাদ ২০-২২ জন যুবক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে স্টাফরুমে। তাদের লক্ষ্য, অঙ্কের শিক্ষক অমরজিৎ কুণ্ডু। তিনি বই পড়ছিলেন। অমরজিতের অভিযোগ, ‘‘ছেলেগুলো ঘরে ঢুকেই গালিগালাজ করতে থাকে আমায়। তার পরে ঘিরে ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, পরিচালন সমিতির ভোট নিয়ে যেন মাথা না ঘামাই। শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের দিন যেন না আসি।’’

অমরজিৎ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আরও খেপে ওরা আমায় দুমদাম মারতে থাকে। পরে জানে মারার হুমকি দিয়ে চলে যায়।” আতঙ্কিত হয়ে অধ্যক্ষের ঘরে বিষয়টি জানাতে যান তিনি। পিছু-পিছু ঢোকে যুবকেরাও। অধ্যক্ষকেও নানা ভাবে হুমকি দিতে থাকে তারা। অধ্যক্ষ বলেন, “ওরা বলতে থাকে, ওদের কথা না শুনলে আমার কলেজে ঢোকা বন্ধ করে দেবে।”

কোন ‘কথা’ শুনতে বলছিল ওরা?

অধ্যক্ষ বলেন, “একটা কাগজ ছুড়ে দিয়ে ওরা বলে: এতে যে সব নাম আছে সেগুলোই যেন পরিচালন সমিতিতে যায়।” ওই কাগজে এক জন শিক্ষিকা ও তিন জন শিক্ষকের নাম ছিল। অধ্যক্ষ ও অমরজিৎ ছাড়া এ দিন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহ ও আত্রেয়ী পাল, রসায়ন শিক্ষক সঞ্জয় ধাড়াকেও হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

কারা করল এই কাজ? অধ্যক্ষের মতে, “তৃণমূলের নাম করে কিছু স্বার্থান্বেষী এই কাজ করেছে। আগেও টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি জয়া দত্ত নিজে এসে এদের সংযত হতে বলে গিয়েছিলেন।” স্টাফরুমে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলেও অধ্যক্ষের ঘরে ছিল। তাতে যুবকদের কাণ্ডকারখানা ধরা পড়েছে। পুলিশ সেই ফুটেজ খতিয়ে দেখছে।

কলেজ সূত্রের খবর, দীর্ঘদিন পরিচালন সমিতির রাশ কংগ্রেস বিধায়ক তথা পুরপ্রধান অজয় দে-র হাতে ছিল। বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে তৃণমূলে যোগ দিয়ে জোটপ্রার্থী তথা যুব কংগ্রেস নেতা অরিন্দম ভট্টাচার্যের কাছে তিনি হারেন। এর পরেই ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে গিয়েছে। আগে বেশ কয়েক বার শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক বা ভোটাভুটি না হলেও এ বার সেই সম্ভাবনা প্রবল। তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অমরজিৎ কুণ্ডু ও নবেন্দু বসাকের মতো কিছু শিক্ষক।

অরিন্দমের অভিযোগ, ‘‘ছাত্র নামধারী কিছু সমাজবিরোধীকে দিয়ে কলেজে ফের ক্ষমতা কায়েম করতে চান অজয় দে।’’ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য শান্তনু চক্রবর্তীর দাবি, “পরিচালন সমিতির সভাপতি হতে মরিয়া অজয়বাবু। সিসিটিভি ফুটেজে তাঁর অনুগামী মনোজ সরকারদের দেখাও যাচ্ছে।”

মনোজের দাবি, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের স্টাইপেন্ডের ফর্মে সই না করে মিটিং করছিলেন অধ্যক্ষ। তারই প্রতিবাদ করেছি। পিস্তল-ফিস্তলের কথা জানা নেই।’’ অজয়বাবুর বক্তব্য, “২০১৩ সালে সভাপতি পদ ছাড়া ইস্তক কখনও কলেজ নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ভিত্তিহীন অভিযোগ, উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না।”

কিন্তু এ দিনের ঘটনা যে রাজ্যের শিক্ষাচিত্রে একটি কালো দাগ হয়ে থাকল, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। অধ্যক্ষের কথায়, ‘‘ভাবতে পারছি না, কলেজে ঢুকে কেউ এ ভাবে শিক্ষকের মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ধরতে পারে।’’ ভাবতে পারছে না রাজ্যের শিক্ষা মহলও। কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুটা এবং ওয়েবকুপা এর নিন্দা করেছে। বিভিন্ন জনের কথায় বারবার ফিরছে নকশাল আমলে শিক্ষকদের সামনে বেঞ্চে ছুরি গেঁথে পরীক্ষা দেওয়া বা আগ্নেয়াস্ত্র ধরার প্রসঙ্গও।

এক সময়ের আগমার্কা নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করছেন, এমন ঘটনা নকশাল বা বামপন্থী ছাত্রেরা কখনও ঘটায়নি। তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেসের মাস্তানেরা, ছাত্র পরিষদের কিছু ছেলে ’৭২ সালে এ রকম কিছু ঘটনা ঘটিয়েছিল। এই লুম্পেন কালচার তো ওদেরই। ওরাই এখন তৃণমূল হয়েছে।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যৌবনের জয়গান করেন, এ সব যুবকদের শোধরানোর কথা বলেন না!’’

N3

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE