Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রাস্তায় কাদা, তাকে তোলা নতুন জুতো

হরিরামপুর গ্রামের মুখে আটপৌরে চায়ের দোকানটার হাল ফিরে গিয়েছে বর্ষায়। ফোটানো চা, লেড়ো বিস্কুট আর বোঁদের লাড্ডুর হাতছানিতে নয়। বরং বাস থেকে নেমে, দোকানের পিছনে, দরমার বেড়া ঘেরা আড়ালটুকু এখন হরিরামপুরের অপরিহার্য আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কেন?

স্কুলের পথে রোজ এ ভাবেই যাতায়াত পড়ুয়াদের। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির হরিরামপুর গ্রামে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

স্কুলের পথে রোজ এ ভাবেই যাতায়াত পড়ুয়াদের। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির হরিরামপুর গ্রামে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বিমান হাজরা
সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪১
Share: Save:

হরিরামপুর গ্রামের মুখে আটপৌরে চায়ের দোকানটার হাল ফিরে গিয়েছে বর্ষায়।

ফোটানো চা, লেড়ো বিস্কুট আর বোঁদের লাড্ডুর হাতছানিতে নয়। বরং বাস থেকে নেমে, দোকানের পিছনে, দরমার বেড়া ঘেরা আড়ালটুকু এখন হরিরামপুরের অপরিহার্য আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কেন?

গ্রামের এন্তাজ আলি বলছেন, ‘‘এক হাঁটু কাদা ভাঙতে হবে তো, তাই ধুতি-পাৎলুন ছেড়ে, ওই ঘেরাটোপে লুঙ্গিটা গলিয়ে নিচ্ছেন যে সকলে!’’

প্রথমে পায়ের পাতা, তার পরে গোড়ালি শেষতক হাঁটু— ভরা শ্রাবণে পাঁকে পরিপূর্ণ সে রাস্তা না ভেঙে, মুর্শিদাবাদের ওই প্রান্তিক গ্রামে প্রবেশ নিষেধ। গত আড়াই মাস ধরে সেই কাদা-পাঁক নিয়েই শুয়ে আছে হরিরামপুরের প্রবেশ পথ।

এঁটেল মাটির সেই কাদা-পথ ভেঙেই রোজ স্কুল-যাত্রা ওদের— নীলিমা, রুবেন, বিকাশ। কেউ তৃতীয় কেউ বা পঞ্চম শ্রেণি। মাসখানেক আগে, গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের বারান্দায় সব্বাইকে জড়ো করে এক জোড়া কালো কুচকুচে জুতো তুলে দিয়ে ‘হেডস্যারের’ অমোঘ নির্দেশ ছিল— ‘‘রোজ পরে আসবি কিন্তু।’’

সে ডাকে কেউ সাড়া না দিয়ে পারে? তৃতীয় শ্রেণির রুবেন বলছে, ‘‘স্কুল ব্যাগে রোজ ভরে নিই জুতো জোড়া। তারপর কাদা ভেঙে বড় রাস্তায় উঠে, পুকুরে পা ধুয়ে জুতোটা পড়ে নিই।’’ বয়ঃসন্ধির বিকাশের অবশ্য সাহস বেশি, বলছে, ‘‘স্যার তো বলেই খালাস, কিন্তু ওই রাস্তায় জুতো পরা যায়!’’ বাড়ির তাকেই তোলা আছে তার সাধের কালো জুতো। বলছে, ‘‘স্কুল থেকে ফিরেই রোজ একবার নামিয়ে দেখে নিই। বর্ষাটা যাক, একেবারে পুজোয় পড়ব জুতো জোড়া!’’

পূর্ণিমা আর বিজয় পড়ে পাশের গ্রাম মির্জাপুরের স্কুলে। কিন্তু স্কুলের পথ তো একটাই। পূর্ণিমা জানায়, এ যাবত, এক জোড়া হাওয়াই চটির বেশি জোটেনি তার। জীবনের প্রথম জুতো জোড়া আজও পায়ে ওঠেনি কিশোরীর। বলছে, ‘‘খুব ইচ্ছে হয়, কিন্তু ওই রাস্তায় জুতো পড়ে গেলে আর থাকবে?’’

দু’বছর আগে, লোকসভার মুখে ঘটা করে রাস্তা ঢালাই শুরু হয়েছিল সাগরদিঘির ওই গ্রামে। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, ভোট ফুরোতেই সে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে বাঁধানো অংশটুকুর পরেই সে রাস্তা এখন আবাদি জমির চেহারা নিয়েছে।

অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। গ্রামের বাসিন্দা অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “পাশেই সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গ্রামের মানুষ ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে জমি দিয়েছিলেন, হরিরামপুরের উন্নয়নের শর্তে।’’ কিন্তু আট বছর পরেও তাদের সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে (সিএসআর) রাস্তার সংস্কার চেয়ে বার বার আবেদন করেও সাড়া মেলেনি।

গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের প্রণব প্রামাণিক বলছেন, ‘‘আসলে কি জানেন, গত বিধানসভা নির্বাচনে, এ গ্রাম থেকে তৃণমূল তো তেমন ‘লিড’ পায়নি। তাই হরিরামপুরের দিকে সরকারের চোখ পড়ে না।’’

স্থানীয় বিধায়ক, শাসক দলের সুব্রত সাহা অবশ্য বরাভয় দিচ্ছেন, ‘‘ও সব রটনা। বর্ষাটা যাক নিশ্চয় বাঁধানো রাস্তা হবে ওখানে।’’

আর বর্ষায়? সপ্তম শ্রেণির বিজয় বলছে, ‘‘তাকেই তোলা থাকবে আমার জুতো!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

New Shoe Sagardighi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE