Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রণাম করলেন পুত্র, প্যাঁচ কষলেন পিতা

বিধানসভার অলিন্দে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন ছেলে। দিল্লিতে বসে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোক্ষম প্যাঁচ কষলেন বাবা। মুকুল রায়-শুভ্রাংশু রায়কে ঘিরে আজ তোলপাড় আরও বাড়ল তৃণমূলের অন্দরে! ক’দিন আগেই দলনেত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে মুকুল-পুত্র বলেছিলেন, “আমার বাবাকে অপমান করা হচ্ছে। আমার কাছে বাবার সম্মানের চেয়ে কিছুই বড় নয়।” শুক্রবার অমিত মিত্রের বাজেট বক্তৃতা শুরুর আগে অধিবেশন কক্ষে ঢোকার সময় মমতার সঙ্গে দেখা শুভ্রাংশুর। এবং তৎক্ষণাৎ ঢিপ করে পা ছুঁয়ে প্রণাম। মমতা তাঁকে বললেন “ভালো থেকো।” তার পর দু’জনেরই ঢুকে পড়লেন অধিবেশন কক্ষে।

শহরে সৌজন্য  বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেই প্রণাম করলেন মুকুল-পুত্র। মমতা বললেন, ভাল থেকো।— নিজস্ব চিত্র।

শহরে সৌজন্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেই প্রণাম করলেন মুকুল-পুত্র। মমতা বললেন, ভাল থেকো।— নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

বিধানসভার অলিন্দে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন ছেলে। দিল্লিতে বসে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোক্ষম প্যাঁচ কষলেন বাবা।

মুকুল রায়-শুভ্রাংশু রায়কে ঘিরে আজ তোলপাড় আরও বাড়ল তৃণমূলের অন্দরে!

ক’দিন আগেই দলনেত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে মুকুল-পুত্র বলেছিলেন, “আমার বাবাকে অপমান করা হচ্ছে। আমার কাছে বাবার সম্মানের চেয়ে কিছুই বড় নয়।” শুক্রবার অমিত মিত্রের বাজেট বক্তৃতা শুরুর আগে অধিবেশন কক্ষে ঢোকার সময় মমতার সঙ্গে দেখা শুভ্রাংশুর। এবং তৎক্ষণাৎ ঢিপ করে পা ছুঁয়ে প্রণাম। মমতা তাঁকে বললেন “ভালো থেকো।” তার পর দু’জনেরই ঢুকে পড়লেন অধিবেশন কক্ষে।

শুভ্রাংশু আচমকা কেন প্রণাম করলেন, অতঃপর তাই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল এমনকী মমতার ঘনিষ্ঠ মহলেও। কেউ বলছেন, প্রণামে অসুবিধা কি? কিন্তু অনেকেরই ধারণা, একেবারে হিসেব কষেই মমতাকে প্রণাম করেছেন মুকল-পুত্র। বাবা যেমন দল-বিরোধী একটাও কথা না-বলে ভিতরে ভিতরে দলকে যত দূর সম্ভব বিড়ম্বনায় ফেলছেন, ছেলেও সেই পথে হাঁটলেন। প্রকাশ্যে তিনি দেখালেন, তাঁর সৌজন্যের অভাব ঘটেনি। আড়ালে যে ভাবে চলছেন, সেই ভাবেই চলবেন।

বস্তুত দিল্লিতে আজ সেই কাজটাই করেছেন মুকুল নিজে। রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা এবং সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁকে সরানো যখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, তখন একদা যুব তৃণমূল সভাপতি পদ থেকে শুভেন্দু অধিকারীর অপসারণ নিয়ে মুখ খুললেন তিনি। পরোক্ষে প্রশ্ন তুললেন ওই পদে মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বসানো নিয়ে। শুভেন্দুকে সরিয়ে প্রথমে সৌমিত্র খানকে যুব সভাপতি করা হয়। তার কিছু দিন পরেই তৃণমূল যুবা সংগঠন তুলে দিয়ে ওই পদে আনা হয় অভিষেককে। এ দিন ভ্রম সংশোধনের ভঙ্গিমায় মুকুল বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে তরুণ প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান শুভেন্দু অধিকারী। তাঁকে তৃণমূলের রাজ্য যুব সভাপতির পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তের পিছনে আমার বড় ভূমিকা ছিল। আমিও ওই প্রয়াসের শরিক ছিলাম। ওই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ভুল ছিল। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, শুভেন্দুর হাতে যুব আন্দোলনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলে সেটা দলের জন্য ভাল।” এর পরই তিনি বলেন, “যদিও এটা দলের ফোরামে বলাটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমি আপনাদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরে এই ভুল স্বীকার করে নিলাম।”

তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, শুভেন্দুর প্রসঙ্গ তুলে কার্যত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন মুকুল। তৃণমূলের বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে যাঁরা বিেজেপির দিকে ঝুঁকে, সেই তালিকায় শুভেন্দুরও নাম আছে। সেই সূত্রে এক সময়ের বিরোধ মিটিয়ে কাছাকাছি চলে এসেছিলেন শুভেন্দু-মুকুল। কিন্তু মুকুলের ডানা ছাঁটার পর্ব শুরু হতেই তমলুকের সাংসদকে কৌশলগত ভাবে বাড়তি গুরুত্ব দিতে শুরু করেন মমতা। দলীয় বৈঠকে শুভেন্দুকে বিশেষ দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন। নিজের গাড়িতে চাপিয়ে কালীঘাটের বাড়ি থেকে নবান্নে নিয়ে গিয়ে একান্তে বৈঠক করেন। নবান্নে নিজের ঘরের লাগোয়া ছাদে একত্রে সারেন সান্ধ্য পায়চারি। তৃণমূল নেতাদের একাংশ বলছে, বর্তমান যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেকের তুলনায় শুভেন্দুর যোগ্যতা বেশি, এ কথা বলে তাঁর সম্পর্কে মমতার মনে অবিশ্বাস তৈরি করতে চেয়েছেন মুকুল। যার জেরে শুভেন্দু এখন ঘোরতর অস্বস্তিতে, জানাচ্ছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল।

পাশাপাশি, তৃণমূলের অভিষেক-বিরোধী গোষ্ঠীকে বার্তা দেওয়ার প্রয়াসও মুকুলের মন্তব্যের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিষেককে যখন দলের যুব শাখার সর্বেসর্বা করে নিয়ে আসা হয়, তখন তৃণমূলের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, স্বজনপোষণের। আড়ালে আবড়ালে কেউ কেউ অভিষেককে ‘তৃণমূলের রাহুল গাঁধী’ এমনকী ‘যুবরাজ’ বলেও ডাকতে শুরু করেছেন। তৃণমূল সূত্র বলছে, দলের অসন্তুষ্ট এই গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের বীজ বোনাই সম্ভবত মুকুলের লক্ষ্য। সেই সঙ্গে অভিষেককেও চাপে রাখলেন তিনি।

মুকুলের এই কৌশলী আক্রমণের মুখে এখন কী করবে তৃণমূল? মমতা শিবিরের দাবি, মুকুলের কোনও মন্তব্যের প্রভাবই এখন আর দলের উপর পড়বে না। একদা দলের দু’নম্বরের প্রায় সব ডানাই ছাঁটা হয়েছে। আগামিকাল কলকাতায় দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁর বাকি পদগুলিও ছাঁটা হবে। ঘনিষ্ঠ মহলে অভিষেকও বলেছেন, এ সব কথাকে কোনও গুরুত্ব দিতে তিনি নারাজ। মুকুল নিয়ে কোনও রকম আলোচনায় যেতে চাইছেন না মমতাও। বাজেট পেশের পরে সাংবাদিক বৈঠকে মুকুলের প্রসঙ্গ তুলতেই চটে যান তিনি। প্রশ্ন পুরোটা না-শুনেই উঠে পড়েন।

শনিবার বিকেলে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সংসদীয় দলের যাবতীয় পদ থেকে মুকুলকে সরিয়ে দেওয়া হবে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। তিনি এখন রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা এবং দুই কক্ষ মিলিয়ে তৃণমূলের সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান। এর মধ্যে প্রথম পদটিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দলনেতা ও মুখ্যসচেতকের পদই সরকারি ভাবে স্বীকৃতি পায় সংসদে। বলা হচ্ছে, রাজ্যসভার নেতার পদটি পেতে পারেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। সে ক্ষেত্রে রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক (যে পদে এখনও পর্যন্ত রয়েছেন ডেরেক) পদটি দেওয়া হবে সুখেন্দুশেখর রায়কে।

যে হেতু সুখেন্দুবাবু ছিলেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের উপনেতা, তাই তিনি মুখ্য সচেতক হলে উপনেতার পদটি খালি হবে। সেটি পূরণ করবেন দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সংসদীয় দলের চেয়ারম্যানের পদটিই অবলুপ্ত করে দেওয়ার কথা ভাবছেন মমতা। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল সাংসদের কটাক্ষ, “এর পরে প্রথম বার জেতা এক জন সাংসদের যা দর, মুকুলেরও তাই হয়ে যাবে!”

আগামিকাল সংসদে বাজেট পেশ হলেও ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে কলকাতা ফিরে যাচ্ছেন তৃণমূল সাংসদরা। দিল্লিতে শুধু কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায় এবং ডেরেককে থেকে যেতে বলা হয়েছে। মুকুলকেও বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি ‘সংসদীয় এবং ব্যক্তিগত কাজের’ কারণ দেখিয়ে যাচ্ছেন না।

মুকুলকে গুরুত্বহীন করার পাশাপাশি তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে টানার কাজও শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। বুধবার বিধানসভায় মমতার ঘরে দেখা গিয়েছে মুকুল-ঘনিষ্ঠ বিধায়ক সব্যসাচী দত্তকে। সে দিন এসেছিলেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকিও। কয়েক দিন আগে ত্বহার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মুকুল। ত্বহার ঘনিষ্ঠরা তখন জানিয়েছিলেন, মমতার প্রতি সন্তুষ্ট নন পীরজাদা। বুধবার ত্বহার উপস্থিতিতেই ফুরফুরা শরিফের উন্নয়নে প্রকল্প ঘোষণা করেন মমতা। এ ব্যাপারে ত্বহার সঙ্গে সবিস্তার আলোচনার জন্য দলনেত্রীর নির্দেশে আজ সন্ধ্যায় ফুরফুরা শরিফে যান পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম।

অন্য দিকে, এ দিকে মুকুল যেমন দিল্লিতে ঘাঁটি গেড়ে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছেন, তৃণমূল সাংসদরাও তেমনই যোগাযোগ রেখে চলেছেন মোদী সরকারের নেতাদের সঙ্গে। গত কাল রেল বাজেটের পর ডেরেক এবং কল্যাণ দেখা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে। প্রায় সোয়া ঘণ্টা বৈঠক হয়। তৃণমূল সূত্রের দাবি, বিতর্কিত জমি বিল নিয়ে অবস্থান নরম করার আর্জি নিয়েই তাঁদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজনাথ। ডেরেকের কথায়, “আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি কৃষকের ১০০ শতাংশ মত ছাড়া জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। এই অবস্থান লঘু করা অসম্ভব।”

যদিও বিজেপি সূত্রের পাল্টা দাবি, মমতার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শিবাজী পাঁজার বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের মামলা নিয়ে দরবার করতেই রাজনাথের কাছে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেতারা। ওই সূত্রের বক্তব্য, শিবাজির গ্রেফতারির পর থেকেই মোদী সরকার সম্পর্কে অবস্থান পাল্টে গিয়েছে তৃণমূলের। ৯ মাস মোদীর ছায়া এড়িয়ে চললেও অবশেষে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছেন মমতা। আবার তৃণমূল নেতাদের একাংশের মতে, মুকুলকে কোণঠাসা করাই এখন দলনেত্রীর প্রধান কাজ। সেই কারণেই বিভিন্ন মাধ্যমে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন তিনি। মুকুলই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় কাঁটা।

সেটা যে কতটা, তার প্রমাণ এ দিন মিলল হাতেগরম। আজ সন্ধ্যায় বিধানসভা চত্বরে সপার্ষদ হাঁটতে বেরিয়েছিলেন মমতা। কথা হচ্ছিল নানা গাছ নিয়ে। একটি আম গাছ দেখিয়ে জনৈক মন্ত্রী বললেন, “দিদি এ বার কত মুকুল এসেছে দেখেছো?’ গম্ভীর মমতার জবাব, “ওগুলোকে আমের বোল বলে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC mukul roy shruvangshu roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE