Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নিছকই আবেগ, না অন্য লক্ষ্যে মুকুলপুত্র

তিনি কেন হঠাৎ এমন বললেন? এ কি তাঁর নিজের কথা? নাকি তাঁকে দিয়ে ‘বলানো’ হল? কথাগুলো কি আবেগের বশে বলে ফেলা, নাকি পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা? বৃহস্পতিবার রাতে রানাঘাটে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়ের বিতর্কিত বক্তৃতা নিয়ে এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে, তৃণমূলের অন্দরেও। স্বাভাবিক কারণেই দলের বড়-মেজো-ছোট কোনও নেতা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। তা বলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা তো থেমে নেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০৩:২০
Share: Save:

তিনি কেন হঠাৎ এমন বললেন? এ কি তাঁর নিজের কথা? নাকি তাঁকে দিয়ে ‘বলানো’ হল? কথাগুলো কি আবেগের বশে বলে ফেলা, নাকি পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা?

বৃহস্পতিবার রাতে রানাঘাটে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়ের বিতর্কিত বক্তৃতা নিয়ে এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে, তৃণমূলের অন্দরেও।

স্বাভাবিক কারণেই দলের বড়-মেজো-ছোট কোনও নেতা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। তা বলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা তো থেমে নেই। তাতেই পরিষ্কার, মুকুল রায়ের বিধায়ক-পুত্র শুভ্রাংশুর এই বক্তব্যকে দলের একটা অংশ ‘ছেলেমানুষের আবেগ’ বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেও শিকড় অনেক গভীরে।

দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় সর্বশেষ রদবদলে শুভেন্দু অধিকারীকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে হালে দলে আসা মুকুল-ঘনিষ্ঠ নব্য সাংসদ সৌমিত্র খানকে যুব তৃণমূলের সভাপতি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি হয়েছেন তরুণ বিধায়ক শুভ্রাংশু।

তৃণমূলের গোষ্ঠী রাজনীতিতে মুকুল ও শুভেন্দুর অহি-নকুল সম্পর্কের কথা অজানা নয়। তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে শুভেন্দুও সেই সময় ক্ষোভ গোপন করেননি। পাশাপাশি ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে নিয়েছেন স্বয়ং মমতার ভাইপো, তৃণমূল যুবার সর্বেসর্বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দলের ভিতরে মুকুলকে কিছুটা চাপে রেখে অভিষেক ক্ষমতার আর একটি ভরকেন্দ্র হয়ে উঠছেন বলেও তৃণমূলে বিস্তর গুঞ্জন জারি আছে। যদিও কোনও স্তরেই প্রকাশ্যে একটি শব্দও শোনা যায় না।

এই অবস্থায় শুভ্রাংশুর মুখে সহসা টেন্ডার-রাজ, গরু পাচার থেকে শুরু করে সাট্টা-জুয়া-চোলাইয়ের কারবারে দলীয় কর্মীদের জড়িয়ে পড়ার কথা ও তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দেওয়াকে মমতার উদ্দেশে মুকুল-লবির বার্তা হিসেবে দেখছেন অনেকে।

যুব তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি শুভেন্দু ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দলের অন্দরে এবং প্রকাশ্যে প্রায়ই টেন্ডার-রাজ কায়েম করা এবং তোলাবাজির অভিযোগ তুলেছেন হলদিয়ার বিধায়ক শিউলি সাহা। দলে তিনি মুকুলবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলেছেন মুকুল ঘনিষ্ঠরা। এমনকী মমতার ভাইপোর দ্রুত উত্থান নিয়েও ইদানীং দলের অন্দরে নানা কথা উড়ে বেড়ায়। সেই গুঞ্জনের পিছনেও মুকুলপন্থীদের ছাপ দেখেন অনেকে। ফলে শিউলির পর এ বার মুকুল-পুত্রের জেহাদ ঘোষণার মধ্যে অনেকে দূরগামী পরিকল্পনার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

শুভ্রাংশু বৃহস্পতিবার তাঁর ওই বক্তৃতায় বলেছেন, “পেটে গামছা বেঁধে রাজনীতি হয় না, সেটা আমিও জানি। কিন্তু দলটাকে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করব, সেটা কিন্তু চলবে না। আপনাদের আবার বলছি, আমার নামে ধ্বনি দেওয়া, মুকুল রায়ের নামে ধ্বনি দেওয়ার কোনও দরকার নেই। এখানে নেত্রী এক জনই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”

একই ভাবে দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়েও সরাসরি আঙুল তুলেছেন শুভ্রাংশু। তাঁর বক্তব্য, “কে সিন্ডিকেট চালাবে, কে গরুর ব্যবসা করবে, কে কয়লার ব্যবসা করবে, কে সাট্টা করবে, জুয়ার ঠেক চালাবে এই নিয়েই ব্যস্ত, এই নিয়েই খুন।”

নদিয়ার শান্তিপুরে সম্প্রতি তৃণমূল যুবার এক নেতা খুন হন। এই ঘটনায় পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দলীয় রাজনীতিতে তিনি মুকুলপন্থী বলে পরিচিত। এ নিয়ে দলে ব্যাপক টানাপড়েনও চলে। পুলিশের খবর, খুন হওয়া এবং অভিযুক্ত দুই নেতার মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরেই বিবাদ চলছিল। দু’জনের সঙ্গেই অস্ত্র কারবারিদের যোগসূত্র মিলেছে বলে দাবি পুলিশের। সেই প্রসঙ্গের ইঙ্গিত করে শুভ্রাংশু ওই সভায় বলেন, “নদিয়ায় ইদানীং কালে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে, সেটা কি মানুষ মেনে নিচ্ছে? এটা কিন্তু ঠিক নয়। আমরা, নেতারা এটা প্রশ্রয় দিচ্ছি। নেতাদের দোষেই এটা হচ্ছে।”

দলীয় সভায় দাঁড়িয়ে মুকুল-তনয়ের এই সব কথা তাই অনেকের কাছেই অর্থবহ মনে হয়েছে। মুকুল-অভিষেক ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে শুভ্রাংশুর এই বক্তব্য পূর্ব-পরিকল্পিত বলেও মনে করছেন তাঁরা। দলীয় সূত্রের খবর, দীর্ঘ বক্তৃতার যে অংশগুলি শুভ্রাংশু নোট করে নিয়ে এসেছিলেন, তাতে টেন্ডার-রাজ, তোলাবাজি, সাট্টা-জুয়া-গরুর ব্যবসা ইত্যাদি ছিল। ছিল দলীয় কোঁদলের কথাও। সে সব কথা বলার সময় কিছুটা তিনি নিজে থেকেও যোগ করেন।

শুভ্রাংশুর এই বক্তৃতায় দল, বিশেষ করে শীর্ষ নেতৃত্ব যে অস্বস্তিতে পড়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। অধিকাংশ নেতা যে ভাবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তা থেকেই এটা পরিষ্কার। দল শুভ্রাংশুকে সতর্ক করবে কি না, সে প্রশ্নেরও কোনও জবাব তৃণমূলের অন্দরে মেলেনি। আর মুকুল রায় নিজে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে যা বলেছেন, তার মর্মার্থ হল, এ ভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। শুভ্রাংশু ছেলেমানুষের আবেগ থেকেই বলে ফেলেছেন। এর মধ্যে অন্য কোনও অর্থ খোঁজা ভুল। শুভ্রাংশুর নিজের কৈফিয়ৎও তা-ই।

তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহ শুধু প্রকাশ্যে জানতে চেয়েছেন, “এটা কি শুধু শুভ্রাংশুর বক্তব্য? মমতাদি সততার প্রতীক। দলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। দিদি তো দেন না। তা হলে কারা দিলেন?”

কিন্তু একটি বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান। তা হল, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের ঠিক আগে কার্যত দলের দিকে আঙুল তুলে মুকুল-পুত্র যে ‘বোমা’ ফাটালেন মমতা কি তাঁর বক্তৃতায় তার কোনও উত্তর দেবেন?

কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত তৃণমূলের সাংগঠনিক কাঠামো প্রকৃত অর্থে মুকুলের কব্জায়। এই অবস্থায় মুকুল-লবি যদি ‘সক্রিয়’ হয়, তা হলে এখনই তার পাল্টা গোষ্ঠী হালে কতটা পানি পাবে, সংশয় সেখানেও। সারদা তদন্তের মতো বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে দলের অন্দরমহল এখন জেরবার। সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত এগোলে কোন স্তরের কোন নেতা কী ভাবে জড়িয়ে পড়বেন, সে সব নিয়েও দলে শঙ্কা যথেষ্ট। শুভ্রাংশুর বক্তৃতা এবং তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ক্ষেত্রে এমন ভাবনাও শোনা যাচ্ছে যে, মুকুল-তনয়ের মুখ দিয়ে বলানো কথায় হয়তো বোঝাতে চাওয়া হয়েছে, কেউ নিজে ‘বেঁচে’ অন্যকে ‘ফাঁসানোর’ চেষ্টা করলে তা সফল হবে না। এক-দু’জন ফাঁসলে সে তালিকা লম্বা হবে।

তাই দলের একাংশের ধারণা, বিষয়টি নিয়ে এখনই নির্দিষ্ট ভাবে মুখ না-ও খুলতে পারেন নেত্রী। যদি তিনি সামগ্রিক ভাবে দলে সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ইত্যাদি বন্ধের কথা বলেন, তা হবে নিতান্তই তাত্ত্বিক অবস্থান। যাতে সাপ পুরোপুরি মরবে না, লাঠিও ভাঙবে না। তবে মমতার কাছে একটি ‘বার্তা’ যে মুকুল-পুত্রের মাধ্যমে পৌঁছে গেল, তা অস্বীকার করছেন না কেউ। নেত্রী সেটা কী ভাবে দেখেন, তা স্পষ্ট না-হওয়া পর্যন্ত এই মুহূর্তে তাই দলের শীর্ষ নেতাদের কৌশল হল, মুখ বুজে থাকা।

কিন্তু দলের মধ্যে তোলাবাজি, টেন্ডার, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দিকে আঙুল তুলে শুভ্রাংশু কি তাঁদের নিজেদের পায়ের তলার জমিটাও আলগা করে দিলেন না? শুক্রবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি যে সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, এক সময় বিরোধীরা সে সব নিয়েই অভিযোগ তুলত আপনার দিকে।” কী বলবেন? তাঁর উত্তেজিত জবাব ছিল, “কে বলেছে, কে অভিযোগ করেছে, কবে বলেছে? নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তবেই এ সব বলবেন। না হলে এ ভাবে বলবেন না। তা হলে দ্বিতীয় দিন আপনাদের সঙ্গে আর কথা বলব না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhransu roy mukul roy tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE