Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাফল্যের দাবি-বেলুন ফাঁসাল বিশ্বব্যাঙ্ক

বিরোধী শিবির তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করবে, বিদ্রুপ করবে, প্রতিবাদ করবে— স্বাভাবিক। কিন্তু এ বার বিশ্বব্যাঙ্কও নস্যাৎ করে দিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাঙ্গীণ সাফল্যের গালভরা দাবি।

প্রভাত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৮
Share: Save:

বিরোধী শিবির তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করবে, বিদ্রুপ করবে, প্রতিবাদ করবে— স্বাভাবিক। কিন্তু এ বার বিশ্বব্যাঙ্কও নস্যাৎ করে দিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাঙ্গীণ সাফল্যের গালভরা দাবি।

মমতা যখন-তখন বলে থাকেন, ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁর সরকারের ১০০ শতাংশ কাজই সারা। এই দাবির ঢক্কানিনাদ ধাক্কা খেয়েছে জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের কাজ সম্পর্কে বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া রিপোর্টে। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া ১৩৮০ কোটি টাকার প্রকল্পে মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছে ওই দফতর!

পালাবাদলের পরে শাসনভার পেয়েই মমতা যে-কুড়ি দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, ‘জল ধরো, জল ভরো’ তার অন্যতম। কিন্তু ওই কর্মসূচির প্রধান পরিচালক জলসম্পদ উন্নয়ন দফতর কী কাজ করেছে, তার নিদারুণ হিসেব দিয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক। ভারতে বিশ্বব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিরেক্টর ওনো রুল রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে লিখেছেন: ‘জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের অধীন এবং বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া অর্থসাহায্যে অ্যাক্সিলারেটেড ডেভেলপমেন্ট অব মাইনর ইরিগেশন প্রজেক্ট (অ্যাডমিপ)-এর কাজ আদৌ সন্তোষজনক নয়। এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০১৭-র ডিসেম্বরে। কিন্তু তার মধ্যে প্রকল্প শেষ হবে, এমন কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না।’ বিশ্বব্যাঙ্কের পরিদর্শকদল সরেজমিন সমীক্ষায় দেখেছে, প্রকল্পের সর্বস্তরেই ঢিলেঢালা অবস্থা। কেন এই অবস্থা, সেই রোগটাও ধরে দিয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক। রুল তাঁর চিঠিতে লিখেছেন: অর্থের অভাব নেই। কাজ হয়নি নিছক প্রশাসনিক শিথিলতার জন্যই।

বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরে ২০১১ থেকে ১৮টি জেলায় মোট ১৪১৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১২৯৮টি মঞ্জুর হয়। সেগুলো রূপায়ণের জন্য খরচ ধরা হয় ১৩৮০ কোটি টাকা। মমতা নিজের সরকারের সাফল্যের ঢাক বাজাতে শুরু করেছিলেন তাঁর শাসনকালের বছর দুয়েকের মধ্যেই। তখন মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ছিল, তাঁর সরকার ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলেছে। সম্প্রতি একটি বাংলা সংবাদ চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিনি জানান, ১০০ শতাংশ কাজ শেষ করার পরে আরও কী কী করা যায়, তিনি নাকি সেটাই হাতড়াচ্ছেন!

কিন্তু পাঁচ বছর পরে, বিধানসভার আরও একটি ভোট পর্বে পৌঁছে দেখা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর ১০০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার দাবি তো অনেক দূরের ব্যাপার, ৫০ শতাংশ কাজও করে উঠতে পারেনি জলসম্পদ উন্নয়ন দফতর। অ্যাডমিপ-এর হিসেব বলছে, বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল সরকার ২০১১-র ২০ মে থেকে ’১৬-র ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১২৯৮টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৩৯৬টি অর্থাৎ ৩০.৫০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছে। আরও ৩৬৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। কাজ শেষ হয়েছে এবং কাজ চলছে, এমন মোট ৭৬০টি প্রকল্প ধরা হলে বাকি ৪১.৪৫ শতাংশ কাজের কোনও হদিস নেই।

এই প্রকল্পে কী কী কাজ হয়?

জলসম্পদ দফতর সূত্রের খবর, অ্যাডমিপ-এ কাজের মধ্যে আছে ক্ষুদ্রসেচের জন্য হাল্কা ও মাঝারি ক্ষমতার নলকূপ বসানো, নদীর জল তোলার জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাম্পের ব্যবস্থা করা, কুয়ো খোঁড়া ইত্যাদি।

কোথায় কতটা কাজ হয়েছে?

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে: বাড়তি জল আছে, এমন জেলাগুলিতে কাজ হয়েছে অনেকটাই। যেমন জলপাইগুড়িতে ৭২, কোচবিহারে ৬০, উত্তর দিনাজপুরে ৪৬, মালদহে ৩৩ এবং জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে ২৮টি প্রকল্প শেষ। কিন্তু বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ার মতো যে-সব খরাপ্রবণ জেলায় ক্ষুদ্রসেচের প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি, সেখানে ওই প্রকল্পের অবস্থা শোচনীয়। যেমন পুরুলিয়ায় ১২৬টি প্রকল্পের মধ্যে কাজ হয়েছে মাত্র ১৫টির। বাঁকুড়ায় ১০৮টি প্রকল্পের মধ্যে শেষ হয়েছে ১৯টি। বীরভূমে ১৩৭টির মধ্যে ১৮টি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে ৭৭টির মধ্যে ১৮টির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। দার্জিলিঙে প্রকল্প ৩৩টি এবং মুর্শিদাবাদে ২৮টি। ওই দুই জেলাতেই পাঁচটি করে প্রকল্পের কাজ সাঙ্গ হয়েছে। হাওড়ায় মঞ্জুর হয়েছে ২৭টি প্রকল্প। কিন্তু পাঁচ বছরে শেষ হয়েছে মাত্র ছ’টির কাজ।

টাকার জোগান থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের এই হাল কেন?

‘‘আমরা প্রকল্পের যে-নকশা তৈরি করেছিলাম, বিশ্বব্যাঙ্ক তার অনেকটাই পরিবর্তন করতে বলে। নানা স্তরে পরিবর্তন হয় নিয়মবিধিরও। তাই দেরি হয়ে গিয়েছে। তবে যতটুকু কাজ হয়েছে, সবটাই হয়েছে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ভাবে,’’ বলছেন জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ, পদাধিকারবলে সচিব কিশোরকুমার নাগচৌধুরী।

মুখ্যমন্ত্রী নিজের প্রশাসনের ঢাক যতই বাজান, সচিবের স্বীকারোক্তিই বলে দিচ্ছে, অর্থের অঢেল জোগান থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলায় ক্ষুদ্রসেচের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ বিশেষ করে উঠতে পারেনি তাঁর সরকার। যেমন হয়নি উপকূলীয় পরিবেশ বাঁচানোর কাজও। সেই প্রকল্পেও কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে টাকা ঢেলেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। ‘ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট’ (আইসিজেডএমপি) বা সুসংহত উপকূল পরিচালন প্রকল্প শুরু হয় ২০১০-এর ডিসেম্বরে। ২০১৫ সালের শেষে প্রকল্পের প্রথম পর্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে সেই কর্মসূচির হাল দেখে বিশ্বব্যাঙ্ক তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। রাজ্যের পরিবেশ দফতরের এক কর্তা জানান, অনেক আবেদন-নিবেদনের পরে উপকূল প্রকল্প শেষ করার জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়তি সময় মিলেছে।

একই ভাবে অ্যাডমিপ-এর কাজ শেষ করার সময়সীমা আরও অন্তত দু’বছর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ তথা সচিব কিশোরবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

World Bank Success
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE