Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
নিজেই চাইলেন সিবিআই

সুদীপ্তর আর্জি মঞ্জুর, জেরা নিতুর সঙ্গেই

ভরা এজলাসে শুনানি শুরু হবে। হঠাৎই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে পড়লেন অভিযুক্ত। বললেন, “স্যার আমার কিছু বলার আছে।” আড়চোখে এক বার অভিযুক্তের দিকে তাকালেন বিচারক। ফের একই আর্জি! এ বার অনুমতি মিলল। আর অনুমতি পেয়েই অভিযুক্ত বললেন, “স্যার, আমি সিবিআই হেফাজতে যেতে চাই। সিবিআই-কে আমার অনেক কথা বলার আছে।”

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫৩
Share: Save:

ভরা এজলাসে শুনানি শুরু হবে। হঠাৎই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে পড়লেন অভিযুক্ত। বললেন, “স্যার আমার কিছু বলার আছে।” আড়চোখে এক বার অভিযুক্তের দিকে তাকালেন বিচারক। ফের একই আর্জি! এ বার অনুমতি মিলল। আর অনুমতি পেয়েই অভিযুক্ত বললেন, “স্যার, আমি সিবিআই হেফাজতে যেতে চাই। সিবিআই-কে আমার অনেক কথা বলার আছে।”

ঘটনাস্থল বৃহস্পতিবারের আলিপুর আদালত। অভিযুক্তের নাম সুদীপ্ত সেন। তাঁকে হেফাজতে চেয়ে বুধবারই আদালতে আর্জি জানায় সিবিআই। তদন্তের স্বার্থে সুদীপ্তকে যে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের হেফাজতে নিতে চাইবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সুদীপ্তর অবস্থান। গত মঙ্গলবার সিউড়ি আদালতের বাইরে তিনি জানান, সিবিআই হেফাজতে যেতে চান। এ দিন আদালতে শুনানি শুরুর আগে সকলকে চমকে দিয়ে সেই আর্জিই এল সুদীপ্তর কাছ থেকে।

তাঁর আবেদন মেনে নেন আলিপুর আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হারাধন মুখোপাধ্যায়। ২৬ অগস্ট পর্যন্ত সিবিআইয়ের হেফাজতে থাকবেন সুদীপ্ত। বুধবার ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুকে গ্রেফতার করে সিবিআই। এ দিন আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে তাঁকেও ২৬ অগস্ট পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।

সারদা কেলেঙ্কারিতে যে প্রভাবশালীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তার ইঙ্গিত দিয়ে গত মঙ্গলবার সিউড়ি আদালতের বাইরে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন সুদীপ্ত সেন। বলেন, “সিবিআইয়ের এখনও অনেককে ডাকা বাকি রয়েছে। সম্পত্তিগুলো সব লুঠ হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল সেন কমিশন আমার কোনও কথাই শুনছে না।” এ কথা বলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ দিন তিনি যে ভাবে নিজেই যেচে সিবিআই হেফাজতে গেলেন, তাকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। এমন ঘটনা স্মরণকালের মধ্যে ঘটেছে বলে মনে করতে পারলেন না আলিপুর আদালতের প্রবীণ আইনজীবীরাও।

সবে বুধবার সারদা কাণ্ডে এ রাজ্যে গ্রেফতারি শুরু করেছে সিবিআই। প্রথমেই তারা হাতকড়া পরিয়েছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুকে। কিন্তু নিতু যে শুধুই একটা কান, এবং তাঁকে টানলে মাথারা আসবেন, সে কথা একান্তে বলছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্তারাই। এ দিন সুদীপ্ত নিজে থেকে সিবিআই হেফাজতে যেতে যাওয়ায় সেই ‘মাথা আসা’র সম্ভাবনা জোরালো হল বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রথমে আদালত, তার পরে সিজিও কমপ্লেক্সে জেরার পরে রাতে যখন তাঁকে সল্টলেকের ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানায় আনা হয়, সাংবাদিকরা জানতে চান, নিতু ছাড়া এই কেলেঙ্কারিতে আর কেউ জড়িত কি? এখানেও খুব তাৎপর্যপূর্ণ জবাব সুদীপ্তর। বলেন, “অনেকেই জড়িত।”

সুদীপ্তকে এর আগেও হেফাজতে নিয়ে জেরা করেছে সিবিআই। এ বারে ‘সারদা কনস্ট্রাকশন’ সম্পর্কিত ন’টি মামলা একত্রিত করে নতুন ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। বৃহস্পতিবার সেই মামলারই শুনানি ছিল।

এ দিন সুদীপ্তর চোখেমুখে কিছুটা ধকলের ছাপও নজরে এসেছে। আদালতে তিনি জানান, বুধবার সারা রাত ঘুমোননি। জেলে থাকা নিয়ে অসুবিধা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিচারক। উত্তরে সুদীপ্ত বলেন, “জেলে পর্যাপ্ত সাহায্য পাচ্ছি।” বিচারক সারদা-কর্তার কাছে জানতে চান, তিনি কেন সিবিআই হেফাজতেই থাকতে চাইছেন? উত্তরে সুদীপ্ত বলেন, “টানা সতেরো মাসের মধ্যে পনেরো মাসই পুলিশি হেফাজতে রয়েছি। সিবিআই হেফাজতে থাকতে আমার কোনও অসুবিধা নেই।”

এ দিন বেলা সওয়া এগারোটা নাগাদ জেল থেকে সুদীপ্তকে আদালতে আনা হয়। মুখ যে খুলছেন, এজলাসে ঢোকার আগে সেটাই আরও এক বার বুঝিয়ে দিলেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে সুদীপ্ত তখন জানান, “দফায় দফায় দেবব্রতবাবু (নিতু) অনেক টাকাই নিয়েছেন। দেবব্রতবাবু দাবি করেছিলেন, সেবি-র কয়েক জন কর্তার সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম রয়েছে। সেবি-র কর্তাদের তুষ্ট করতেই আমার কাছ থেকে টাকা নেন দেবব্রতবাবু।”

এর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে, বেলা দু’টো নাগাদ নিতুকে আদালতে নিয়ে আসে সিবিআই। পরে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ নিতু ও সুদীপ্তকে নিয়ে সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সে নিজেদের অফিসে ঢোকে তারা। সেখানে আলাদা ভাবে দু’জনকে জেরা করা হয়। তদন্তকারীরা জানান, সারদা কাণ্ডের সঙ্গে সেবি-র যোগ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা এবং একই সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে সারদার চুক্তি নিয়েও জেরা চলে। বস্তুত, এই যোগসূত্রগুলি আতসকাচের তলায় ফেলে দেখতেই এ দিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে নিতুকে জেরা শুরু করে সিবিআই। মাঝে শুধু কিছু ক্ষণের জন্য আদালতে তোলা হয়েছিল।

সিবিআই সূত্রের দাবি, জেরায় কলকাতার এক প্রাক্তন সেবি কর্তা-সহ কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম জানিয়েছেন নিতু। আরও কিছু তথ্য দিয়েছেন। এ দিন আদালতে সিবিআই আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্তের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যে সব নথি মিলেছে, সেগুলি সারদা কেলেঙ্কারিতে নিতুর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ। জেরায় ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে সারদার একটি চুক্তি নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত খোঁজখবর করেন গোয়েন্দারা। সিবিআইয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে সারদার পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। কিন্তু সেই হিসেব রাত পর্যন্ত পুরোপুরি মেলেনি। হিসেব মেলাতে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের ফের ডাকা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সিবিআই কর্তারা। এ দিন রাত ন’টা নাগাদ নিতুকে বিধাননগর (উত্তর) থানার লক-আপে পাঠানো হয়। সিবিআই দফতর থেকে বেরোনোর সময় সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “যা বলার পরে বলব।”

সিবিআইয়ের পাশাপাশি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও (ইডি) সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে তৎপর হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে ইডি-র তদন্তকারীরা বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে জেরা, সারদাকে তাঁর বিক্রি করা কারখানায় গিয়ে তদন্তের সঙ্গে বোলপুরে সারদার কোপাই রিসর্টটিও দেখে আসেন। ইডি সূত্রের খবর, দেবাশিস সাহা নামে কলকাতার এক বাসিন্দার কাছ থেকে ৫ কোটি টাকায় এই রিসর্টটি কিনেছিল সারদা। এ দিন দেবাশিসবাবুকে নিজেদের দফতরে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর কাছে রিসর্ট বিক্রির নথিপত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন তদন্তকারীরা।

এ দিনই ইডি-র এক কর্তা জানান, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানকে হাজির হওয়ার জন্য তিন বার চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি উত্তর দেননি। আগামী সোমবারের মধ্যে ইডি দফতরে হাজিরা না দিলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাতে ইমরান জানান, লোকসভা ভোট চলাকালীন ইডি-র দু’টি চিঠি তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের কাজে ব্যস্ত থাকায় হাজিরা দিতে পারেননি। সে কথা তিনি ইডি-কে চিঠি ও ই-মেল মারফত জানিয়েছিলেন। ইমরানের দাবি, “ইডি-র তৃতীয় চিঠি এখনও হাতে পাইনি। পেলে ইডি-র বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই হাজিরা দেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE