একই দিনে জোড়া ধাক্কা!
আরও এক বার আগাম জামিন নামঞ্জুর করল আদালত। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা থেকে পৌঁছে গেল বার্তাও। জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতির পদে তিনি আর নেই! মঙ্গলবার এ ভাবেই ক্ষমতাচ্যুত হলেন বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পিটিয়ে শিরোনামে আসা সুদীপ্ত ঘোষ।
দুর্গাপুজোর আগে সিউড়ি জেলা আদালতে সুদীপ্তর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। এ দিন একই আবেদন নামঞ্জুর হল বোলপুর আদালতে। এর পরেই দলের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব তত্পর হন বলে দল সূত্রের খবর। জেলা যুব সভাপতির পদ থেকে সুদীপ্তকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন সংগঠনের নতুন রাজ্য সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘটনা বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের (কেষ্ট) কাছেও ‘বিশেষ বার্তা’ পৌঁছে দেবে বলে মনে করছেন তৃণমূলের একাংশ।
ঘটনা হল, এই প্রথম বীরভূমে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ কোনও নেতাকে এ ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা মঙ্গলবার রাতে বলেন, “আমাদের দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপেই ছেঁটে ফেলা হল সুদীপ্তকে। আমাদের জেলা সভাপতি শীর্ষ নেতৃত্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, তা শোনা হয়নি। আসলে দলের সবাইকেই মাথায় রাখতে হবে, অন্যায় করে বেশিদিন পার পাওয়া যাবে না!” বস্তুত, অভিষেক নিজেও এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, দল করতে গেলে দলের শৃঙ্খলা ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে হবে। তাঁর মন্তব্য, “যাঁরা এটা করতে পারবেন না, তিনি যত বড় নেতা বা কর্মীই হোন না কেন, তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা সকলে যেন মনে রাখেন।”
৩ সেপ্টেম্বর রাতে বোলপুর থানায় ঢুকে এক পুলিশকর্মীকে মারধরের ঘটনায় নাম জড়ানোর পর থেকেই পর থেকেই সুদীপ্ত ঘোষকে নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। তার পরেও ‘ও(সুদীপ্ত) খুব ভালো ছেলে। ও এমন করতে পারে না’ বলে নিজের অনুগামী যুবনেতাকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। ফলে, সুদীপ্তর বিরুদ্ধে সুয়ো-মোটো (স্বঃপ্রণোদিত) মামলা রুজু করার পরেও তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার ‘সাহস’ হয়নি পুলিশের। ওই ঘটনার পরেও বারবার বোলপুরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে সুদীপ্ত এবং ঘটনায় অভিযুক্ত অন্যদের। এক জনকেও পুলিশ ধরতে পারেনি। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, শাসকদলের নেতা হওয়াতেই পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে আছে। পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া নিজেই বলেছিলেন, ‘পুলিশ কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে’।
পরিস্থিতি ঘুরতে শুরু করে সিউড়ি আদালতে সুদীপ্তর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর থেকে। খোদ সরকারি আইনজীবী জামিনের পক্ষে সওয়াল করলেও বিচারক আর্জি নামঞ্জুর করে দেন। এ দিন বোলপুর আদালতে আদালতের (ভ্যাকেশন বেঞ্চ) অতিরিক্ত জেলা জজ সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরীর এজলাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। বিচারক প্রথমেই জানতে চান, সিউড়িতে আবেদন নাকচ হওয়ার পরেও তাঁরা ফের কেন একই আবেদন করেছেন। সুদীপ্ত-সহ অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী তথা জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় বিচারককে বলেন, “আমার মক্কেল সুদীপ্ত ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী, দু’জনেই অসুস্থ। প্রয়োজনীয় চিকিত্সার জন্য তাঁদের ভেলোরে যাওয়া দরকার। তাই আগাম জামিনের আবেদন জানিয়েছিলাম।” মলয়বাবু মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জমা দিয়ে সুদীপ্তর আগাম জামিনের আর্জি জানান। সেই আবেদনের বিরোধিতা করেননি সরকারি আইনজীবী রণজিত্ গঙ্গোপাধ্যায়। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, বোলপুর থানায় কোনও হামলা হয়নি। সুদীপ্ত কোনও পুলিশকর্মীকে মারধরও করেননি। বিচারক অবশ্য সেই যুক্তিতে সায় দেননি। সুদীপ্তর আগাম জামিনের আর্জি তিনি খারিজ করেন।
আদালত থেকে বেরিয়ে সরকারি আইনজীবী দাবি করেন, “বোলপুরে মদ, গাঁজা, ড্রাগসের রমরমা ব্যবসা চলছে। অথচ পুলিশ নীরব দর্শক। এই বিষয়টি জানানোর জন্যই সুদীপ্ত ঘোষ সে দিন (৩ সেপ্টেম্বর) থানায় গিয়েছিলেন। সামান্য বচসা ও ধাক্কাধাক্কা হয়েছিল মাত্র। পুলিশকে মারধরের কোনও ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের এই অভিযোগ সঠিক নয়। এবং কাম্যও নয়। আদালতকে সে কথাই জানিয়েছি।” তাঁর সুরেই সুদীপ্তর আইনজীবীও দাবি করেন, পুলিশই মিথ্যা মামলায় তাঁর মক্কেলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
আদালতে অবশ্য কোনও যুক্তিই হালে পানি পায়নি। ফলে, তৃণমূল নেতৃত্ব বুঝতে পারছিলেন, এর পর উচ্চ আদালতে গেলেও একই জিনিস হতে পারে। তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে। আর তার অনিবার্য পরিণাম, সুদীপ্তর পদ খোওয়ানো।
তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, বছর চারেক আগে কলকাতায় তৃণমূল ভবনে জেলার যুব সভাপতি পদে সুদীপ্তর নাম ঘোষণা করেছিলেন খোদ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তত্কালীন জেলা যুব সভাপতি, এক সময়ের দাপুটে ছাত্রনেতা সিউড়ির অভয় ভট্টাচার্যকে সরিয়ে সুদীপ্তকে আনায় দলের মধ্যেই চাপা গুঞ্জন হয়েছিল। কারণ, অভয়বাবুর সঙ্গে জেলা সভাপতি অনুব্রতর সম্পর্ক বড় একটা ‘মধুর’ ছিল না! সুদীপ্তর নিজেরও উত্থান বোলপুর কলেজে ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে। তখন অবশ্য তিনি ছাত্র পরিষদে। আর অভয়বাবু ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি। দল সূত্রের খবর, অভয়বাবুকে সরিয়ে যুব সভাপতির পদে আসার পর থেকে অনুব্রতর ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে ওঠেন সুদীপ্ত। বোলপুর পুরসভার কর্মী হওয়ায় দলীয় কার্যালয়ে যথেষ্ট সময় দেওয়া এবং সব সময় অনুব্রতকে খুশি রাখার ক্ষেত্রে ত্রুটি দেখা যায়নি।
জেলার এক তৃণমূল নেতার কথায়, “অনুব্রত মণ্ডলের এতটাই বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন সুদীপ্ত, যে গত বছর বোলপুরে শুভেন্দু অধিকারীর (তত্কালীন যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি) সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে দেখা গিয়েছিল সুদীপ্তকে। অনুব্রত-ঘনিষ্ট দলের নেতাদের সঙ্গে বরাবর সুসম্পর্ক বজায় রেখে দলের নিজের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন তিনি।” কিন্তু, দলের নেতা-কর্মীদের একাংশ সুদীপ্তর ব্যবহারে খুব খুশি ছিলেন না। পুলিশের উপরে ‘দাদাগিরি’ করার অভিযোগও একাধিক বার উঠেছে সুদীপ্তর বিরুদ্ধে।
এ দিন তাঁর ডানা ছাঁটার খবর পেয়ে জেলা তৃণমূলের একাংশ খুশি। বিশেষ করে, অনুব্রত-বিরোধী শিবির। কেউ প্রকাশ্যে মন্তব্য না করলেও আড়ালে অনেকে বলছেন, “আগেই এটা হওয়া দরকার ছিল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy