Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ডান হাত ছেঁটে বার্তা কি অনুব্রতকেও, প্রশ্ন দলেই

দায়িত্ব পাওয়ার চার দিনের মাথাতেই বীরভূমে যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন রাজ্য সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল জমানায় এই প্রথম বীরভূমে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ কারও ডানা ছাঁটা হলো। এর মধ্য দিয়ে তৃণমূলে এ বার ‘যুবরাজে’র জমানা শুরু হয়ে গেল বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

ত্রয়ী। মাঝে অনুব্রত, বাঁয়ে সুদীপ্ত, ডানে মনিরুল।  ফাইল চিত্র

ত্রয়ী। মাঝে অনুব্রত, বাঁয়ে সুদীপ্ত, ডানে মনিরুল। ফাইল চিত্র

মহেন্দ্র জেনা ও দয়াল সেনগুপ্ত
বোলপুর শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

দায়িত্ব পাওয়ার চার দিনের মাথাতেই বীরভূমে যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন রাজ্য সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল জমানায় এই প্রথম বীরভূমে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ কারও ডানা ছাঁটা হলো। এর মধ্য দিয়ে তৃণমূলে এ বার ‘যুবরাজে’র জমানা শুরু হয়ে গেল বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

কিছু দিন আগে বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর দায়ে অভিযুক্ত সুদীপ্তকে ক’দিন আগেই ‘ভাল ছেলে’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন অনুব্রত। সুদীপ্ত জেলায় অনুব্রতর ডান হাত বলেই পরিচিত। এখন দল সুদীপ্তর মাথার উপর থেকে হাত তুলে নেওয়ায় তাঁর গ্রেফতার হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছেন অনুগামীরা। মঙ্গলবার সরকারি আইনজীবী রীতি ভেঙে সুদীপ্তর হয়ে সওয়াল করলেও আদালত আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করেছে।

তৃণমূলের অন্দরের খবর, সুদীপ্তকে পদচ্যুত করে দলের নেতা-কর্মীদের কাছে একটি নির্দিষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন অভিষেক। শুধু সুদীপ্ত নয়, এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে আদতে জেলা সভাপতি অনুব্রত এবং লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলামের জন্যও বার্তা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। দলের সাম্প্রতিক সাংগঠনিক পরিবর্তনের পরে অনুব্রত-মনিরুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের অনুগামীরা চিন্তিত। দলে এখন যে অ-মুকুলায়নের পর্ব শুরু হয়েছে, সেই নিরিখে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবা হচ্ছে। এটা ঠিকই, অতীতে যত বারই নানা ঘটনা ও বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে অনুব্রতর নাম সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ‘ভাল সংগঠক’ বলে প্রশংসা করেছেন। যত এমন হয়েছে, তত বেশি করে অনুব্রতর প্রতিপত্তি বেড়েছে। জেলায় তিনিই দলের মুখ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন যখন দলীয় সংগঠনে কার্যত দু’নম্বর আসনে থাকা মুকুল রায়েরই ক্ষমতা ছাঁটা হচ্ছে, তার রেশ যে অন্যান্য দাপুটে নেতার উপরেও পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা দলেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

নতুন দায়িত্ব পেয়ে দলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর অভিষেক এ দিন বলে দিয়েছেন, “দল করতে গেলে দলের শৃঙ্খলা ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে হবে। যাঁরা এটা করতে পারবেন না, তিনি যত বড় নেতা বা কর্মীই হোন তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা সকলে যেন মনে রাখেন।” অনুব্রত-মনিরুলকে নিয়ে নানা বিতর্কের প্রেক্ষিতে এই মন্তব্য আলাদা করে ইঙ্গিতবাহী হতে পারে বলে দলের একাংশের ধারণা।

চার বছর আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাত ধরেই জেলা যুব তৃণমূলে সভাপতির পদ পেয়েছিলেন সুদীপ্ত। তার পর থেকে তিনি কার্যত অনুব্রতর ডান হাত হয়ে ওঠেন। মঙ্গলবার সংগঠন থেকে তাঁর বিদায় সুনিশ্চিত করে অভিষেক অ-মুকুলায়নকেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন বলে দলের একাংশের মত। এ দিন অভিষেক বলেন, “আমাদের নতুন কমিটিতে ও (সুদীপ্ত) থাকছে না, এটা বলে দিচ্ছি।” পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের সূত্রে জানা যায়, সুদীপ্তকে সংগঠন থেকেই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অভিষেকের আগে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মুকুল-ঘনিষ্ঠ সাংসদ সৌমিত্র খান। সুদীপ্তর বিরুদ্ধে কেন সৌমিত্রবাবুরা ব্যবস্থা নেননি, দলের মধ্যে এখন সেই প্রশ্ন উঠেছে। সদ্য পদ হারানো সৌমিত্রবাবু শুধু বলেছেন, “সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলা বারণ।”

এ ব্যাপারে সুদীপ্তর প্রতিক্রিয়া অবশ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল বেজে গিয়েছে। এসএমএস-এরও জবাব দেননি। তবে জেলায় তাঁর ‘গুরু’ অনুব্রত মণ্ডল জানাচ্ছেন, “আমার কাছে এ ধরনের (সুদীপ্তকে দায়িত্ব থেকে সরানোর ব্যাপারে) কোনও নির্দেশ আসেনি।”

সারদা কেলেঙ্কারি এবং খাগড়াগড় নিয়ে বিপর্যস্ত দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টায় সংগঠনে রদবদল এনেছেন তৃণমূল নেত্রী। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরানোর ডাক দেওয়া হয়েছে। এর পরেই ধূপগুড়িতে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনে অভিযুক্ত তৃণমূল কাউন্সিলরের স্বামী-সহ ৫ জনকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করে রেল পুলিশ। রবিবার উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি পদে জেলার যুব তৃণমূল নেতা গৌতম পালের নাম উঠলেও পরে তাঁর নাম বাদ পড়ে। গৌতমবাবু কলেজে টোকাটুকির ঘটনায় অধ্যক্ষা-নিগ্রহে অভিযুক্ত। এ বার কোপ পড়ল পুলিশ-নিগ্রহে অভিযুক্ত সুদীপ্ত ঘোষের উপরে।

অভিষেকের বিবৃতি আসার আগে পর্যন্ত অবশ্য সুদীপ্তর অনুগামীরা প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে, পুলিশ তাঁর টিকি ছুঁতে পারবে না। সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যে ভাবে সুদীপ্তর ‘পক্ষে’ সওয়াল করছিলেন, তাতে আদালতে উপস্থিত পুলিশ কর্তারাও এমনটাই মনে করছিলেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে সুদীপ্ত মদ্যপ অবস্থায় বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ কর্মীদের নিগ্রহ করেন বলে অভিযোগ। তার পরেও এত দিন তিনি বোলপুরেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। শাসক দলের চাপেই পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। যদিও এর আগে সিউড়ি আদালতে সুদীপ্তর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়েছিল। এ দিন বোলপুর আদালতের ভ্যাকেশন বেঞ্চেও অতিরিক্ত জেলা জজ সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরী সুদীপ্ত-সহ অভিযুক্ত ছ’জনের আগাম জামিন নামঞ্জুর করেন।

কিন্তু সরকারি আইনজীবী কি অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করতে পারেন? কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অসীমেশ গোস্বামী বলেন, “সরকারি আইনজীবী অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সওয়াল করতে পারেন না। আইন ও বিচারবিভাগের উচিত তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।” জেলা পুলিশের একাংশও বলছেন, “যাঁর আমাদের হয়ে বলার কথা, তিনি কী ভাবে উল্টো কাজ করলেন, আমরা বুঝতে পারছি না।” যদিও রণজিৎবাবুর দাবি, “আমি কারও হয়ে বা বিরোধিতা করে সওয়াল করিনি। আদালতের কাছে সঠিক তথ্যই তুলে ধরেছি।”

গোটা ছবিটাই অবশ্য বদলে যায় সন্ধেবেলা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য বীরভূমে পৌঁছনোর পরেই সুদীপ্ত আত্মগোপন করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। পুলিশের নিচুতলা অবশ্য এই ঘটনায় কিছুটা হলেও উজ্জীবিত। তাঁদের এখন আশা, এ বার হয়তো গ্রেফতার করা যাবে সুদীপ্ত ঘোষকে। তবে ফোনে যোগাযোগ করা হলে ছুটিতে আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দিয়েছেন বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া। ফোন ধরেননি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়ও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE