বিধানসভায় নিজের ঘরে মুখ্যমন্ত্রী। পিছনে সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং অরূপ বিশ্বাস। ছবি: সুদীপ আচার্য।
সারদা কেলেঙ্কারিতে কার্যত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাঁর দলের। তা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার বিধানসভায় সেই সারদা নিয়েই বিরোধীদের কটাক্ষের মুখে একের পর এক পাল্টা গোলা দাগলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাদবপুরের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ সুজন চক্রবর্তীই সারদাকে ‘তুলেছিলেন’ বলে সটান অভিযোগ করলেন তিনি। নাম নিলেন প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক রবীন দেবেরও। বর্তমানে বিধানসভার সদস্য নন, তৃণমূল নেত্রী এমন দুই নেতার নাম টেনে আনছেন দেখেও চোখে পড়ার মতো কোনও প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি বাম বিধায়কদের। বরং এর পর যেন খানিকটা গুটিয়েই যান তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, এ দিন বিধানসভায় দাঁড়িয়ে তাঁর মন্ত্রিসভার জেলবন্দি সদস্য মদন মিত্রের হয়ে সওয়ালও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিন বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণের উপরে বিতর্কে জবাবি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তখনই তাঁর উদ্দেশে সারদা নিয়ে তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিলেন বিরোধী পক্ষের কিছু বিধায়ক। মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি নিয়েও কটাক্ষ করছিলেন অনেকে “কত টাকায় বিক্রি হল? কে কে কিনল? একটু বলুন না!”
লাগাতার এমন মন্তব্যে মেজাজ হারান মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “আমার ছবি নিয়ে কোনও উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবেন না। ছবি বিক্রির এক টাকাও আমি ঘরে নিয়ে যাইনি। যদি প্রমাণ হয়, তা হলে আমি ইস্তফা দেব।” তৃণমূল নেত্রী জানান, দল চালাতে ওই টাকা খরচ হয়েছে। প্রদর্শনী করে নগদেও তাঁরা ছবি বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু তা করা হয়নি। প্রতিটি ছবি চেকের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। খানিকটা হুঁশিয়ারির সুরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাকে অপমান করুন, কিন্তু মনে রাখবেন আমি এক জন শিল্পীও। আমার শিল্পীসত্তাকে অপমান করবেন না। আমি ছবি আঁকি, গানে সুর দিই, বই লিখি। সেখান থেকে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে দল চালাই। এতে অন্যায় কী আছে?”
এই সময়েই সারদার বাড়বাড়ন্তের যাবতীয় দায় সিপিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী দলনেতাকে উদ্দেশ করে বলেন, “চ্যালেঞ্জ করছি আপনাদের। সারদা গোষ্ঠীকে কে তুলেছিল? আপনাদের সুজন চক্রবর্তী! কেঁচো খুঁড়বেন না, কেউটে বেরিয়ে পড়বে। আপনাদের রবীন দেবকেও তো সিবিআই ডেকেছিল। এত চেঁচাচ্ছেন কেন? সব বলব এখানে?”
দলের দুই নেতার নামে সারদা গোষ্ঠীকে মদত দেওয়ার অভিযোগ শুনেও সূর্যবাবুরা তা এক রকম হজম করে নেন। যদিও বিরোধী দলনেতা পরে বলেন, “সুজনের সঙ্গে যে সারদার যোগাযোগ নেই, আর তৃণমূল যে সারদার টাকা নিয়েছে, তা সকলেই জানেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী সুজনের প্রসঙ্গ টানা মাত্র আমরাও সারদা কর্তার সঙ্গে তাঁর মধ্যরাতে ডেলো বাংলোয় বৈঠক, তাঁর সফরসঙ্গী শিবাজি পাঁজার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি।” সূর্যবাবু এই দাবি করলেও ঘটনা হল, প্রবল হই-হট্টগোলের মধ্যে তাঁদের এ সব কোনও কথাই শোনা যায়নি।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের তির যাঁর দিকে, সেই সুজনবাবু এ দিন বলেন, “আমি ওঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। বিধানসভায় না থাকলে কারও বিরুদ্ধে এ ভাবে বলা যায় না, মুখ্যমন্ত্রী কি সেটা জানেন না? যা-ই হোক, যা বলেছেন, পারলে প্রমাণ করুন।” সেই সঙ্গে, মমতার আঁকা ছবি কত টাকায় বিক্রি হয়েছে, কে কিনেছে, মমতা তার জন্য আয়কর দিয়েছিলেন কি না প্রশ্ন তুলেছেন তিনিও।
বস্তুত, এ দিন অধিবেশনের গোড়া থেকেই সারদা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে আসছিলেন বিরোধীরা। রাজ্যপালের ভাষণের উপরে বিতর্কে বক্তৃতা করার সময় অধ্যক্ষের কাছে বিরোধী দলনেতা জানতে চান, পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র যখন জেলে, তখন তাঁর দফতর কে সামলাচ্ছেন? কারণ, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর বিধানসভাকে জানানো হয়েছিল, সারদা রিয়েলটি মামলায় মদনকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে। অথচ এ বারের অধিবেশনের বুলেটিনে মন্ত্রী হিসেবেই মদনের নাম রয়েছে। এই প্রশ্নের জের টেনেই মমতাকে মোক্ষম খোঁচা দেন বিরোধী দলনেতা। বলেন, “যতক্ষণ না দোষী প্রমাণিত হচ্ছেন, ততক্ষণ যে কেউ মন্ত্রী থাকতেই পারেন। আমাদের কিছু বলার নেই। মুখ্যমন্ত্রীও দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত জেলে থেকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব করতে পারেন। তাতেও কিছু বলার নেই।”
এ কথা বলা মাত্রই ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে শাসক দলের বিধায়কেরা হইহই করে ওঠেন। তখনকার মতো অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী নিজের দলের বিধায়কদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বক্তৃতার সময়েও ছবি নিয়ে একের পর এক কটাক্ষ উড়ে আসতে দেখে আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি তিনি। উত্তেজিত হয়ে এক সময়ে বলেছেন, “আপনারা চচ্চড়ি রান্না করেছেন, এ বার আমাকে মশলাটা দিতে দিন।”
এ দিন মদনের হয়েও সওয়াল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “মদন কী ভুল করেছে? তার কয়েকটা ক্লাবের জন্য স্পনসরশিপের টাকা নিয়েছে। তার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, চিটফান্ড তাঁদের আমলে হয়নি। তা শুরু হয়েছিল বাম জমানায়। চিটফান্ডের অনুমতি দেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, আরওসি। কাজেই দায় তাদেরও আছে। কমিশন গঠন করে তিনিই ৫ লক্ষ লোকের টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ বার সিবিআই ও সেবি চিটফান্ডগুলির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বাকি লোকের টাকা ফেরত দিক। সেই সঙ্গে চিটফান্ড সংস্থা নিয়ন্ত্রণ আইনটি চলতি অধিবেশনেই সংশোধন করে ফের দিল্লির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।
আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বিধানসভায় পৃথক আলোচনার ব্যবস্থা করার জন্যও অধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে আরও একটি জনস্বার্থ মামলা হলে ‘সব বেরোবে’। বস্তুত, এই সময়ে মমতার কথার সূত্রেই কিছুটা হাল্কা হয়ে যায় সভার আবহ।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জগাই-মাধাই গিয়ে মামলা করল, আর সে নিয়ে হইচই হচ্ছে।” বিরোধীরা বলতে থাকেন, “নাম বলুন, নাম বলুন।” মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বলে দিতে পারি। শুনতে ভাল লাগবে তো? সুব্রতদা, বলে দিন তো।” পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় উঠে দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠেন, “মান্নান-বিকাশ!” কথা শেষ হতে না হতেই সভায় হাসির রোল ওঠে। সুব্রতবাবু যে দু’জনের নাম করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম, কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান সব শুনে বলেন, “আমরা যে সঠিক পথে রয়েছি, এতেই তা প্রমাণ হল।”
ঘটনাচক্রে, একই দাবি করেছেন সুজনবাবুও।
সারদার বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন সঠিক জায়গায় আঘাত হেনেছে বলে দাবি করে প্রাক্তন সাংসদ বলেন, “উনি (মমতা) বলুন, সারদার মালিকের সঙ্গে মধ্যরাতে ডেলোর বাংলোয় মিটিং করেছিলেন কি না। ২০০৯ সালে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের কত টাকা ছিল, আর আজ তাঁরা কত টাকার মালিক? মদন মিত্রের ছেলের বিয়েতে কত টাকা খরচ হয়েছিল? সেই টাকা কোথা থেকে এল?”
সুজনবাবু যা-ই বলুন, বৃহস্পতিবার অন্তত মুখ্যমন্ত্রী যে তাঁকে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রবীণ সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “আমি চাইব সুজন এই অপবাদের উপযুক্ত জবাব দিক। আরও তদন্ত হোক। ওদের আরও অনেক কিছু বেরোবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy