দলের দক্ষিণী নেতাদের চাপে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পরে জ্যোতি বসু মন্তব্য করেছিলেন, ‘ঐতিহাসিক ভুল’! এ বার বিধানসভা ভোটের আগে সূর্যকান্ত মিশ্র দলকে বার্তা দিলেন, তৃণমূলকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে জনগণ ও ইতিহাস ক্ষমা করবে না! ‘কুয়োর ব্যাঙ’ মানসিকতা ছেড়ে নমনীয় কৌশলের পক্ষেই সওয়াল করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক।
তৃণমূলের মোকাবিলায় বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে কংগ্রেসের হাতও ধরা হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুক্র ও শনিবার রাজ্য কমিটির বৈঠক বসবে সিপিএমের। তার আগে দলের দক্ষিণবঙ্গের ৯টি জেলার বিধানসভা কেন্দ্রওয়াড়ি প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনী কর্মশালায় সোমবার সূর্যবাবুর বার্তা জোটের পথ আরও প্রশস্ত করল বলেই সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা। এর আগে প্রকাশ্যে কংগ্রেসের প্রতি জোট-বার্তা দিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যবাবু নিজে এবং দলের আর এক পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তাঁরা কেউই যে মতিভ্রম ঘটিয়ে ওই কথা বলেননি, তা-ও এ দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক। যা থেকে বঙ্গ সিপিএমের বড় অংশই মনে করছে, রাজ্য কমিটির বৈঠকের আগে দলের সুর বেঁধে দেওয়ার কাজটাই সেরে রাখা হল এ বার!
রাজ্য সিপিএমের মত জানার পরে আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে বসবে দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। যেখানে প্রকাশ কারাটেরা এখনও জোট-সম্ভাবনায় কাঁচি চালাতে অপেক্ষায় আছেন বলে মনে করে দলের একাংশ! সিপিএম সূত্রের খবর, পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যবাবু প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে কর্মশালার মঞ্চ থেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও কৌশলে বার্তা দিয়ে রেখেছেন। ঈষৎ হাল্কা চালেই তিনি বৈঠকে মন্তব্য করেছেন, কংগ্রেস এখনও সিদ্ধান্ত জানায়নি। ওদের হাইকম্যান্ডের মতো সিপিএমেরও অবশ্য হাইকম্যান্ড (অর্থাৎ পলিটব্যুরো) আছে!
কেন তাঁরা জোট চাইছেন, ইতিমধ্যে একাধিক বার প্রকাশ্যে ও দলের অন্দরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধবাবুরা। প্রথমে দুর্গাপুরে রাঢ়বঙ্গের চার জেলা, তার পরে শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গের ৭টি ও এ দিন কলকাতায় দক্ষিণবঙ্গের ৯টি জেলার কর্মশালায় পেশ-হওয়া নোটেও তার ইঙ্গিত ফের স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে: ‘তৃণমূলী অপশাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে, গণতন্ত্র বাংলার বুকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাজ্যের অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে রুখতে অঙ্গীকারবদ্ধ সিপিএম ও বামফ্রন্টের শরিক দলসমূহ। এই সংগ্রামে যারা যুক্ত হতে ইচ্ছুক, তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করেই অগ্রসর হতে হবে’। অর্থাৎ নাম না করেও কংগ্রেসকে সঙ্গে নেওয়ার তাগিদ পরিষ্কার! ওই নোটে আরও আহ্বান, ‘জনগণের সংগ্রামী জোটকে আরও শক্তিশালী করাই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। তাই বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলি ও বাইরে অবস্থানকারী বামপন্থীরা ছাড়াও আরও বেশি মানুষকে সামিল করেই এই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হচ্ছি আমরা’।
বস্তুত, দিল্লিতে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের দিন যত কাছে আসছে, জোটের পক্ষে যুক্তি সাজাতে ততই যেন ‘আক্রমণাত্মক’ হচ্ছেন সূর্যবাবুরা! এর আগে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের বৈঠকে গিয়ে সূর্যবাবু বলেছিলেন, কংগ্রেস-প্রশ্নে তাঁরা যেন দরজা-জানলা বন্ধ করে না দেন! বরং, খোলা মনে বাস্তবের প্রয়োজনীয়তা বিচার করে দেখেন। এ বারের কর্মশালায় আরও খোলাখুলি ভাবে রাজ্য সম্পাদক সওয়াল করেছেন, তৃণমূলের হাতে রাজ্যের মানুষ বিপন্ন। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার আক্রান্ত। আক্রমণ শুধু বিরোধীদের উপরে নয়, নেমে আসছে সাধারণ মানুষের উপরেও। এই জমানার অবসান ঘটাতে ‘ব্যাপকতর ঐক্য’ দরকার। তৃণমূল যা করছে, তা মাথায় রাখলে কংগ্রেসের সঙ্গে তুলনা আসে না। মানুষ দেখতে চান, তৃণমূলকে হারাতে বিরোধীরা আন্তরিক ভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে কি না। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের অবস্থানের জন্য যদি তৃণমূল-বিরোধী ঐক্যে বাধা পড়ে, তা হলে মানুষ ও ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না— সাফ বার্তা সূর্যবাবুর!
সিপিএমের অন্দরে এবং বামফ্রন্টের মধ্যে একাংশের কংগ্রেস-প্রশ্নে এখনও অনীহা আছে পুরনো কথা বিচার করে। তাঁরা সত্তরের দশকের কংগ্রেস জমানা এবং ‘আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে’র দৃষ্টান্তই ব্যবহার করেন কংগ্রেসকে ‘না’ বলার প্রধান যুক্তি হিসাবে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সূর্যবাবু এ দিন সত্তরের দশকের ইতিহাসকেই পাল্টা যুক্তি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। দলীয় সূত্রের খবর, রাজ্য সম্পাদক বৈঠকে বলেছেন ১৯৭৭ সালে জ্যোতিবাবু-প্রমোদবাবুরা জনতা পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। জনতা পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ৫২% আসন। অথচ জনতা পার্টি বামপন্থী দল ছিল না। তা হলে কি এখন বলা হবে জ্যোতিবাবু-প্রমোদবাবুদের সে দিনের সিদ্ধান্ত আসলে ‘বিচ্যুতি’ ছিল— প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য সম্পাদক।
দলের রাজ্য কমিটির এক বর্ষীয়ান সদস্যের ব্যাখ্যা, ‘‘১৯৭৭ সালে লোকসভা ভোটে ইন্দিরা গাঁধীর কংগ্রেসকে হারাতে জনতা পার্টির সঙ্গে বামেদের জোট হয়েছিল। বিধানসভা ভোটে আসন রফার প্রস্তাব প্রফুল্ল সেনদের পছন্দ না হওয়ায় জোট ভেস্তে যায়। বামফ্রন্ট আলাদা লড়াই করেই জেতে এবং ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এটা ইতিহাস যে, ছয়ের দশকে যে প্রফুল্ল সেনের সরকারের বিরুদ্ধে খাদ্য আন্দোলন করেছিলাম, তাঁদের নেতৃত্বাধীন জনতা পার্টির সঙ্গেই সাতাত্তরে সমঝোতা হয়েছিল। সুতরাং, সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী মূল্যায়ন সব সময়ই বদলায়।’’ বৈঠকে সূর্যবাবু এ দিন জোট-যুক্তিকে ‘সময়ের ডাক’ বলেই বর্ণনা করেছেন।
সিপিএমের একটি সূত্রের বক্তব্য, রাজ্য কমিটির বৈঠকে থাকবেন শুধু সেই কমিটির সদস্যেরা। তিনটি শহরে তিন কর্মশালায় তার তুলনায় অনেক বেশি নিচু তলার নেতা-কর্মীরা হাজির ছিলেন। তাদের সামনে নির্বাচনী প্রস্তুতির নোটে বামফ্রন্টের বাইরের গণতান্ত্রিক শক্তিকে সামিল করার বার্তা দিয়ে এবং জোটের পক্ষে সওয়াল করে আলিমুদ্দিন আসলে কর্মী বাহিনীকে মানসিক ভাবে তৈরি রাখতে চাইছে। কংগ্রেসের হাইকম্যান্ডের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে এবং দলের পলিটব্যুরোর কাঁটা সরিয়ে জোট শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলে সিপিএমের নিচু তলা যাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে! দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘শুধু দু’দলের নেতৃত্ব বসে জোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াই শেষ কথা নয়। মাঠে-ময়দানে যে কর্মীরা লড়াই করবেন, তাঁদের এই সমঝোতা মেনে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা দরকার। আমরা শেষ মুহূর্তের জন্য সেই কাজ ফেলে রাখতে চাইছি না। এর পরে একান্তই জোট না হলে নিজেদের মতো করে লড়াই হবে!’’
শুধু জোট-জল্পনায় না থেকে বুথ সংগ্রাম কমিটি গড়ে ফেলার জন্যও কর্মশালায় কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কী ভূমিকা হবে, সে সবের অপেক্ষায় না থেকে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ঝাঁপাতে হবে বুথ বাহিনীকে। নির্বাচন কমিশনের উপরে কী ভাবে তাঁরা চাপ রাখতে চান, তার ব্যাখ্যাও এ দিনের কর্মশালায় দিয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy