Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শখ মিটিয়ে ঘুরতেই দুই খুদের চম্পট

বুধবার নিজেদের বাড়িতে বসে সেই গল্পই শোনাচ্ছিল বালি নিশ্চিন্দার দেওয়ানচকের বাসিন্দা গৌরব দে আর বালি পঞ্চাননতলার ঋদ্ধি মুখোপাধ্যায়।

 ঘরে ফেরা: (বাঁ দিকে) মায়ের সঙ্গে গৌরব। (ডান দিকে) বাবার কোলে ঋদ্ধি। বুধবার লিলুয়ায়। নিজস্ব চিত্র

 ঘরে ফেরা: (বাঁ দিকে) মায়ের সঙ্গে গৌরব। (ডান দিকে) বাবার কোলে ঋদ্ধি। বুধবার লিলুয়ায়। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৪
Share: Save:

ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ওরা বেরিয়েছিল ঠিকই, তবে চাঁদের পাহাড় খুঁজতে নয়!

ওরা বেরিয়েছিল ঝুলন্ত হাওড়া ব্রিজ দেখতে। ইচ্ছে ছিল, গঙ্গার ঘাটে স্নান করার আর হর্ন বাজিয়ে ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার। এই তিনটি শখ মেটাতেই বেলুড়ের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির দুই পড়ুয়া মঙ্গলবার চম্প়ট দিয়েছিল।

বুধবার নিজেদের বাড়িতে বসে সেই গল্পই শোনাচ্ছিল বালি নিশ্চিন্দার দেওয়ানচকের বাসিন্দা গৌরব দে আর বালি পঞ্চাননতলার ঋদ্ধি মুখোপাধ্যায়। যে দুই খুদেকে খুঁজে পেতে মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরতে হল আত্মীয়-পরিচিত থেকে হাওড়ার পুলিশকর্মীদের। বেলা ১১টা ২০ নাগাদ যে নাটকের শুরু, রাত পৌনে ১১টা নাগাদ তাতে যবনিকা পড়ে। হাওড়া স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের টিকিট কাউন্টারের থামের আড়াল থেকে উদ্ধার করা হয় গৌরব ও ঋদ্ধিকে।

উদ্ধারের খবর পেয়ে হাওড়া জিআরপি থানায় হাজির হন বেলুড় থানার ওসি স্বপন সাহা। কলকাতা ও হাওড়ার বিভিন্ন প্রান্তে তখন তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালাচ্ছেন ঋদ্ধির আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতেরা। শুধু তা-ই নয়, রীতিমতো হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ বানিয়ে তাতে চলেছে বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাওড়ার পুলিশ কমিশনার দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন জেলার দুই
মন্ত্রী অরূপ রায় ও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া। রাতে শিশু দু’টিকে উদ্ধারের পরে ঋদ্ধির বাবা দেবজ্যোতিবাবুকে ফোন করেন বৈশালী। পরে তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজেও তো মা। তাই ওদের কোনও খবর না পাওয়া পর্যন্ত ঘুমোতে পারছিলাম না। উদ্ধারের খবরে স্বস্তি মিলল।’’

সারাটা দিন কেমন কাটল দুই খুদের?

পুলিশ জানায়, পুজোর আগে থেকেই মনটা উসখুস করছিল গৌরবের। তাই চেনা হাওড়া স্টেশন চত্বরকেই সে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু একা তো আর ঘোরা যায় না। তাই স্কুলের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ ঋদ্ধিকেও সঙ্গে নিয়েছিল। বেড়াতে যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে বাবার পকেট থেকে এক হাজার টাকাও হাতিয়েছিল গৌরব। স্কুলের সামনে থেকে ঋদ্ধিকে নিয়ে টোটোয় চেপে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে তারা পৌঁছয় বেলুড় স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে প্রথমে ভুল করে চলে যায় বালি স্টেশনে। পরে আবার ট্রেনে চেপে হাওড়া গিয়ে নামে তারা। ভারী ব্যাগ বইতে না পেরে সেগুলি সাবওয়েতে ফেলে রেখে হাওড়া ব্রিজের ফুটপাথ ধরে হাঁটা দেয় মল্লিকঘাট ফুল বাজারের দিকে।

গঙ্গার ঘাটে কিছু ক্ষণ বসে ফের তারা ফিরে আসে হাওড়ায়। এর পরের গন্তব্য ছিল হাওড়া ময়দান। সেখানে গিয়ে দুই খুদের প্রথমে মনে হয়েছিল, এ বার স্কুলের জামা খুলতে হবে। না হলে পুলিশ ধরবে। এ দিন গৌরব বলে, ‘‘হাওড়া ময়দানের একটা দোকান চিনতাম। সেখান থেকেই ঋদ্ধির কালো আর আমার নীল গেঞ্জি-প্যান্ট, জুতোও কিনেছি।’’ আর ঋদ্ধি বলছে, ‘‘গৌরব রাস্তা থেকে দু’জনের জন্যই ঘড়ি-আংটি কিনেছিল। আখের রস, লস্যিও খেয়েছি।’’ কিন্তু স্কুলের জামা-প্যান্ট কোথায়? লজ্জায় মুখ লুকিয়ে গৌরব বলল, ‘‘একটা গলিতে ঢুকে খুলে ফেলে দিয়েছি।’’ এর পরে মল্লিফ ফটকের এক সিনেমা হলে গেলেও তা বন্ধ দেখে অগত্যা দু’জনে ফের চলে আসে হাওড়া স্টেশনে।

পুলিশ জেনেছে, বাবা মারা যাওয়ার পরে গুজরাতের বাড়ি থেকে গৌরব ও তার মাকে তাড়িয়ে দেওয়ায় তাদের ঠিকানা হয়েছিল হাওড়া স্টেশন। সেখানেই বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে রোজগার করত ছোট্ট গৌরব। এক সময়ে মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। কিন্তু পরে তাঁর আর কোনও খোঁজ পেল না ওই খুদে। শিশু সুরক্ষা কমিটির মাধ্যমে সে পৌঁছে গিয়েছিল একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখান থেকেই ২০১৫ সালে গৌরবকে দত্তক নেয় বালির গৌরীদেবীর পরিবার।

গৌরব বলে, ‘‘আগের মায়ের কথা মনে পড়লে কান্না পায়। কিন্তু এখন বাবা-মা আমায় খুবই ভালবাসে।’’ আর ঋদ্ধি বলে, ‘‘ওকে বললাম, বালি খালের অটোয় তুলে দে। বাড়ি যাই। পায়ে বড্ড ব্যথা করছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Missing student Liluah লিলুয়া
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE