Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মৃত্যুকে হারিয়ে জীবনের জয়গানে কঙ্কণ

জন্ম থেকেই একটা ইন্দ্রিয় তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ৩২ বছর বয়সে আরেকটা ইন্দ্রিয় ফের তাঁর জীবনটাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং চিকিৎসকদের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ালেন কঙ্কণ মাইতি।

স্ত্রী কাকলি এবং চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কঙ্কণ মাইতি। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

স্ত্রী কাকলি এবং চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কঙ্কণ মাইতি। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:০০
Share: Save:

জন্ম থেকেই একটা ইন্দ্রিয় তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ৩২ বছর বয়সে আরেকটা ইন্দ্রিয় ফের তাঁর জীবনটাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং চিকিৎসকদের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ালেন কঙ্কণ মাইতি।

হলদিয়ার বৈষ্ণবচকের বাসিন্দা এই লোকসঙ্গীত শিল্পী জন্মান্ধ। কিন্তু শৈশব থেকেই সুর খেলা করত তাঁর গলায়। তাই নেশার সঙ্গে গানকেই পেশা করেছেন তিনি। জেলার পাশাপাশি কলকাতার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে নিয়মিত গাইতে আসেন কঙ্কণ। মাস কয়েক আগে হঠাৎই তাঁর জিভে একটা ঘা ধরা পড়ে। স্থানীয় ডাক্তার দেখেন, ওষুধ দেন। কিন্তু কমে না। প্রথমে জেলার মেডিক্যাল কলেজ, তার পর কলকাতা। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে রোগটা ক্যানসার। ক্রমশ পরিস্থিতি এমন দিকে যায় যে গান গাওয়া তো দূরের কথা, কথা বলাটাও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কঙ্কণের কাছে। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন তাঁর বাবা পান্নালাল মাইতি। চিকিৎসকেরা দেখে জানান, জিভের বেশ খানিকটা অংশ বাদ না দিলে কঙ্কণকে বাঁচানো যাবে না।

অর্থাৎ যদিও বা বেঁচে যান কঙ্কণ, জিভ বাদ পড়ার অর্থ তাঁর গান আর বাঁচবে না। জন্মান্ধ তরুণ কি জেনেশুনে সেই ধাক্কাটা সামলাতে পারবেন? গোটা পরিবার যখন আসন্ন বিপর্যয়ের কথা ভেবে কাঁটা হয়ে ছিল, তখন অবলীলায় কঙ্কণ জানিয়ে দেন, জীবন যে ভাবে আসবে, তাকে সে ভাবেই স্বীকার করে নেবেন তিনি। কলকাতার হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে জিভের অনেকটা অংশ বাদ যায় তাঁর।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কঙ্কণের জিভের সেই বাদ যাওয়া অংশের পুনর্গঠন হয়। মৃত্যুর পরোয়ানাকে অগ্রাহ্য করে কঙ্কণ ফিরে আসেন জীবনে। কথা বলছেন, গুনগুন করে গান গাওয়াও শুরু হয়েছে। চিকিৎসকদের আশা, খুব শিগগির পুরোদস্তুর গান গাইতে শুরু করবেন তিনি। ই এম বাইপাসে রুবি জেনারেল হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় কঙ্কণের অস্ত্রোপচার করেছিলেন। পরে জিভ পুনর্গঠন করেন প্লাস্টিক সার্জন অনুপম গোলাস। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘ওঁর জীবনীশক্তিটাই আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই জীবনীশক্তিটা খুব জরুরি। শুধু উনি নন, ওঁদের গোটা পরিবার আগাগোড়া ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে আমাদের সাহায্য করে এসেছেন।’’

সাধারণ ভাবে এই ধরনের ক্যানসারে কেমোথেরাপির প্রয়োজন পড়ে না। তবে এ ক্ষেত্রে বায়োপসি রিপোর্ট পাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রেডিয়েশনের প্রয়োজন আছে কি না। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যে হেতু এই ধরনের ক্যানসারে জিভ থেকে গলায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবচয়ে বেশি, তাই বাদ দিতে হয়েছে কঙ্কণের গলার কিছু গ্রন্থিও। তবে সে জন্য ভবিষ্যতে গান গাইতে তাঁর কোনও অসুবিধা হবে না বলেই চিকিৎসকদের আশ্বাস।

প্লাস্টিক সার্জন অনুপমবাবু জানান, মুখের মধ্যের টিস্যু দিয়েই পুনর্গঠিত হয়েছে কঙ্কণের জিভটি। তিনি বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ ভাবে হাত থেকে টিস্যু নিই। কিন্তু কঙ্কণের ক্ষেত্রে সেটা করিনি। কারণ দৃষ্টিহীনদের ক্ষেত্রে হাতের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওঁদের রোজকার জীবনের অনেকটাই হাত দিয়ে ছুঁয়ে ওঁরা অনুভব করেন। তাই সেখানে কোনও ক্ষত তৈরি করতে চাইনি। একটু ধৈর্য্য ধরে মুখের ভিতরকার একাংশ থেকে টিস্যু নিয়েই কাজ চালিয়েছি। হাসপাতাল থেকে স্বামীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে এসে যেন তর সইছিল না কঙ্কণের স্ত্রী কাকলির। বছর পঁচিশের ওই তরুণীর চোখ দিয়েই এখন পৃথিবী দেখেন কঙ্কণ। কাকলি জানালেন, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী আর দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। তাঁর কথায়, ‘‘মাঝখানের ক’টা দিন অসুখের কালো ছায়াটা আমাদের সুখ ঢেকে দিয়েছিল। এখন আবার সব আগের মতো।’’ একই কথা বলেছেন পান্নালালবাবুও।

যে রকম পাঞ্জাবি পরে গানের অনুষ্ঠানে যান, হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার সময়ে তেমনই একটা পাঞ্জাবি পরেছিলেন কঙ্কণ। বাড়ি থেকে তাঁর একতারাটা এনে দিয়েছিলেন কেউ। সেটা হাতে নিয়ে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে থমকালেন। বললেন, ‘‘এই যে আবার আমি গান গাওয়ার কথা ভাবতে পারছি, সেটা ডাক্তারবাবুদের জন্যই। আমি ওঁদের চোখে দেখিনি। কিন্তু ছুঁয়ে অনুভব করেছি। আমার অস্তিত্বের সঙ্গে এখন ওঁরাও জড়িয়ে গিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Life Songs
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE